মূর্তি ও ভাস্কর্য একটি অপরটিকে আকৃষ্ট করে
ইকতেদার আহমেদ
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মূর্তি ও ভাস্কর্য উভয়ই বিশেষ্য। মূর্তির সমার্থক হলোÑ প্রতিমা, আকার, আকৃতি, দেহ, চেহারা প্রভৃতি। অপরদিকে ভাস্কর্যের সমার্থক হলোÑ প্রতিমা বা কাষ্ঠ, প্রস্তর, মর্মর, তাম্র, মৃন্ময়, মনি প্রভৃতির মূর্তি। মূর্তির ইংরেজি ংঃধঃঁব, নড়ফু, রহপধৎহধঃরড়হ. বসনড়ফরসবহঃ, রসধমব, ভড়ৎস, ংযধঢ়ব, ভরমঁৎব, রফড়ষ, ধঢ়ঢ়বধৎধহপব প্রভৃতি, আর ভাস্কর্যের ইংরেজি ংপঁষঢ়ঃঁৎব.
মূর্তি হলো কোনো ব্যক্তি বা প্রাণীর খোদাইকৃত অথবা সাচে ঢালা অবয়ব যা ব্যক্তি বা প্রাণীর আকৃতিসম অথবা বৃহদাকৃতির। এটি সচরাচর ত্রিমাত্রিকরূপে উপস্থাপন করা হয়। সহজে বহনযোগ্য মূর্তিসমূহকে বলা হয় ক্ষুদ্রাকৃতির মূর্তি। মূর্তি খোদাই, মাটিতে প্রতিমালেপ অথবা সাচে ঢালাই করে সৃষ্টি করা হয়। পৃথিবী বিখ্যাত মূর্তিসমূহের অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যাচু অব লিবার্টি, ইতালির মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ডেভিড, ব্রাজিলস্থ রিওডো জেনিরোর ক্রিস্ট দ্য রিডিমির এবং মিশরের গ্রেট স্ফিনিক্স অব গির্জা।
ভাস্কর্য মাটি, পাথর, ধাতু প্রভৃতিতে খোদাই বা লেপনের মাধ্যমে দ্বিমাত্রিক অথবা ত্রিমাত্রিক প্রতিনিধিত্বমূলক বা বিমূর্তভাবে উপস্থাপনকৃত শিল্পকর্ম। যে সকল ভাস্কর্যে মানুষ অথবা প্রাণীর বহিঃপ্রকাশ থাকে সেগুলোকে বলা হয় মূর্তি অপরদিকে যে সকল শিল্পকর্ম মূর্তিহীন বা ভাবনামূলক বা অনবয়ব সেগুলো হলো ভাস্কর্য। সকল মূর্তিকে ভাস্কর্যরূপে আখ্যায়িত করা গেলেও সকল ভাস্কর্যকে মূর্তিরূপে আখ্যায়িত করা যায় না।
যেসব মূর্তিকে সামনে রেখে পূজা অর্চনা করা হয় সেগুলোকে বলা হয় দেবমূর্তি। দেবমূর্তি বিভিন্ন দেবদেবীর কল্পিত অবয়ব। পাথরে খোদাইকৃত বা ধাতব বস্তুর মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত দেবমূর্তি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়। মাটিতে লেপনের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত দেবমূর্তি বিশেষ ধরনের পূজাকে উপলক্ষ করে প্রস্তুত করা হয় এবং পূজা সমাপনান্তে তা পুকুর, নদী বা সমুদ্রের পানিতে বিসর্জন দেওয়া হয়। আবার ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায় মাটি দ্বারা প্রস্তুতকৃত দেবমূর্তি বিভিন্ন উপাসনালয়ে বা গৃহে পরবর্তী পূজার আগমন অবধি সংরক্ষণ করা হয়।
একজন ব্যক্তিমানুষের অবিকল অবয়বে প্রস্তুতকৃত মূর্তি ব্যক্তিটির স্মৃতিকে ধারণ এবং শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশে প্রস্তুতকরত: দেশে-বিদেশের বিভিন্ন স্থান যেমন সড়কদ্বীপ, ভবনস্থ সম্মুখ চত্বর, ভবনের অভ্যন্তর প্রভৃতিতে স্থাপন করা হয়। ব্যক্তিকে উপলক্ষ্য করে নির্মিত মূর্তি দেবমূর্তি না হলেও কোনো বিশেষ দিন যেমন ব্যক্তিটির জন্ম অথবা মৃত্যু দিবস অথবা ব্যক্তিটির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশে ব্যক্তিমূর্তিতে পুষ্পস্তবক প্রদানপূর্বক কিছু সময় এর সম্মুখে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায়। ব্যক্তিমূর্তির প্রতি এভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অন্যান্য ধর্মে নিষিদ্ধ না হলেও ইসলাম ধর্মে এটি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। আবার অনেক সময় দেখা যায় এরূপ ব্যক্তির প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। ইসলাম যেকোনো প্রতিকৃতিতে এরূপ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অনুমোদন দেয় না।
আমাদের দেশে ভাস্কর্যের প্রতিনিধিত্বমূলক ও বিমূর্ত উভয় ধরনের উপস্থাপন রয়েছে যেমনÑ মুজিবনগরে সাত বীরশ্রেষ্ঠর অবিকল অবয়বের প্রতিনিধিত্বমূলক উপস্থাপনের মাধ্যমে যে ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে তা সমভাবে ভাস্কর্য ও মূর্তি। আবার স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ একটি স্মারক স্থাপনা ও ভাস্কর্য। এ ভাস্কর্যটিতে সাতটি ত্রিভূজাকৃতির মিনারের শিখর যথা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্ন, আটান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রতিটি এক ভাবব্যঞ্জনায় প্রবাহিতের বহিঃপ্রকাশ দেখানো হয়েছে যা ভাস্কর্যের বিমূর্ত উপস্থাপন। অনুরূপ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মধ্যস্থলের সুউচ্চ কাঠামো স্নেহময়ী মাতার আনত মস্তক এবং এর দুপাশের দুটি করে ক্রমহ্রস্বতর কাঠামো সন্তানের প্রতীকস্বরূপ স্মারক স্থাপনা ও ভাস্কর্যের বিমূর্ত উপস্থাপন।
প্রাণী বলতে প্রাণ আছে এমন জীবকে বোঝায়। পৃথিবীর সকল জীবই প্রাণী; তবে মানুষের সঙ্গে প্রাণ বিশিষ্ট অপরাপর জীবনের পার্থক্য হলো মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব বা বিবেকবোধ রয়েছে যা অপরাপর প্রাণীর মধ্যে নেই। কোনো প্রাণীর মূর্তি নির্মাণ করা ইসলামি শরিয়তে কঠিন কবিরা গোনাহ ও হারাম। মূর্তির নির্মাণ, কেনাবেচা, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ইত্যাদি সকল বিষয় ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
অনেকে মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে বিধানগত পার্থক্য দেখাতে চান যা কোনোভাবেই সঠিক নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি ও ভাস্কর্য উভয়ই পরিত্যাজ্য। কুরআন মজিদে এ প্রসঙ্গে যে আয়াতসমূহ রয়েছে তা মূর্তি ও ভাস্কর্য উভয়কেই নির্দেশ করে। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদের স্পষ্ট নির্দেশ ‘তোমরা পরিহার কর অপবিত্র বস্তু অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার কর মিথ্যাকথন’। সূরা হজ্জ-৩০। এ আয়াতে পরিষ্কারভাবে সব ধরনের মূর্তি পরিত্যাগ করার এবং মূর্তিকেন্দ্রিক সকল কর্মকা- বর্জন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
কুরআন মজিদের অন্য একটি আয়াতে কাফের সম্প্রদায়ের অবস্থান তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘এবং তারা বলেছিল, তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে এবং কখনো পরিত্যাগ করো না ওযাদ্দ, ইয়াগুচ, উয়াঊক ও নাসরকে। অথচ এগুলো অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে’। সূরা নূহ-২৩-২৪। এ আয়াতে কাফের সম্প্রদায়ের দুটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছেÑ (১) মিথ্যা উপাস্যদের পরিত্যাগ না করা এবং (২) মূর্তি ও ভাস্কর্য পরিহার না করা। এখানে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনার মতো ভাস্কর্যপ্রীতিও কুরআন মজিদে কাফেরদের বৈশিষ্ট্যরূপে চিহ্নিত। আর এ কারণে এটা যে ইসলামে গর্হিত ও পরিত্যাজ্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কুরআন মজিদে মূর্তি ও ভাস্কর্যকে পথভ্রষ্টতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছেÑ ‘ইয়া রব, এরা (মূর্তি ও ভাস্কর্য) অসংখ্য মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে’। সূরা ইবরাহিম-৩৬। কুরআন মজিদে যখন একটি বস্তু সুস্পষ্টভাবে পথভ্রষ্টতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত তখন এটি ইসলামি শরিয়তে কোনোভাবে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এ বিষয়টি প্রতিটি ইসলাম ধর্মাবলম্বীর গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
কুরআন মজিদে মূর্তি ও ভাস্কর্যকে বহুবিধ মিথ্যার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছেÑ তোমরা তো আল্লাহর পরিবর্তে উপাসনা কর (অসার) মূর্তির এবং তোমরা নির্মাণ কর ‘মিথ্যা’। সূরা আনকাবুত-১৭। মূর্তি ও ভাস্কর্য যেহেতু অসংখ্য মিথ্যার উদ্ভব ও বিকাশের উৎস তাই এ আয়াতে একে ‘মিথ্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই উপরোক্ত আয়াতগুলো হতে স্পষ্টত প্রতিভাত মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোই সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য।
ইসলাম ধর্ম মতে, ন্যায়বিচারের প্রতীক হলো দাঁড়িপাল্লা। এটিকে বিবেচনায় নিয়েই আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের মনোগ্রাম তথা প্রতীকে দাঁড়িপাল্লার ছবি অঙ্কিত আছে। আর তাই দাঁড়িপাল্লার অন্য কোনোরূপ উপস্থাপন অনাকাক্সিক্ষত, অপ্রত্যাশিত এবং অনভিপ্রেত। প্রাচীন গ্রিসে দুচোখ কালো কাপড় দ্বারা আবৃত বাম হাতে দাঁড়িপাল্লা ও ডান হতে তলোয়ার ধারণরত দেবী থেমিস এর মূর্তিকে রূপকার্থে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে। এটি মানুষের অবয়বে সৃষ্ট বিধায় এটি যতটুকু না ভাস্কর্য তার চেয়ে অধিক মূর্তি। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখে স্থাপিত মূর্তিটিকে মূর্তি বা ভাস্কর্য যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন তা মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনের উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহের বিশ্লেষণে সার্বিক বিবেচনায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানুষের ধর্মানুভূতিতে কঠোরভাবে আঘাত করে বিধায় তথায় সংরক্ষণের অবকাশ নেই। সুতরাং যতশীঘ্র এটিকে অপসারণ করা হবে তা দেশ ও জাতি এবং বিচার বিভাগের জন্য কল্যাণকর ও মঙ্গলজনক।
রশঃবফবৎধযসবফ@ুধযড়ড়.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান