দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীকেই এগিয়ে আসতে হবে?
হাবীব ইমন
কদিন ধরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। একই সঙ্গে বইছে ঝড়ো হাওয়া। ফলে বৃষ্টির পানিতে ঢাকা শহর অনেকটাই তলিয়ে যেতে বসেছে। এই সমস্যা আজকের নয়, অনেক আগের। প্রতিবছরই সামান্য বৃষ্টিতে ঢাকা শহর তলিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। বিগত সময়ে আন্দোলনে উঠা এই সেøাগানটি নিশ্চয় অবাঞ্চিত নয়Ñ ‘উন্নয়নের নমুনা/বৃষ্টি হলে যমুনা’। সমস্যা, সংকট সামনে আসছে। আমরা সেসব সংকট, সমস্যা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু সমস্যার কার্যকর কোনো সমাধান কী হচ্ছে? সংকট, সমস্যা সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনাগুলোকে নিরর্থক ও ব্যর্থই মনে হয়। আরেকটা ব্যাপার আমরা দেখতে পাচ্ছি, বর্ষার প্রাক্কালে ঢাকা শহরে রাস্তা কাটাকাটি শুরু হয়। এ সময়ে বেশ হিড়িক পড়ে যায় উন্নয়ন কাজের। অসময়ে রাস্তা কাটাকাটিতে অনেক দুঘর্টনাও হচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসন ও বর্ষা মৌসুমে সড়কগুলোর অবস্থা দাড়ায় তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা প্রয়োজন। কিন্তু সেদিকে আমাদের মনোযোগ খুব কমই। এ চিত্র কেবল ঢাকাতেই নয়, পুরো দেশজুড়ে। উন্মুক্ত গণমাধ্যমের সেবাতে জনদুর্ভোগের অনেক ছবিই আমরা দেখছি। আমরা দেখছি রিকশা থেকে পড়ে যাচ্ছে নারীসহ অনেকে। রিকশা-গাড়ি পানিতে অর্ধেক ডুবে যাচ্ছে।
বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে হাওর অঞ্চলে ব্যাপক ফসলহানি হচ্ছে। এটা যে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণে ঘটেছে তা বলা যাবে না। নদী ও হাওরের বিলগুলো নিয়মিতভাবে খনন করার জন্য প্রতিবছর বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করার অজুহাতে প্রকল্পের টাকা সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, ফসল রক্ষা বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি আর ঠিকাদারেরা এ লোপাটের কাজটি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঠিকাদারদের বাঁধ নির্মাণ করার কথা। পরবর্তীতে তারা সময় বাড়িয়ে নিয়েছিল ৩১ মার্চ পর্যন্ত। সেই সময়ের মধ্যেও তারা কাজটি করেনি। ফলে বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে নদীর দুই কূল উপচে হাওরে পানি ঢুকে জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। এ তথ্য ৩৫টি আন্তর্জাতিক ও দেশিয় সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত সংগঠন ‘হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম’ সরকারি উৎস থেকে নেওয়া। তবে স্থানীয় মানুষ মনে করছে, ৫ নয়, ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
ফসলহারা এবং ভাঙনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পরাজিত হচ্ছে লাখো কৃষক। পরিবার-পরিজন, এমনকি গবাদি পশুর খাবার তারা সংগ্রহ করতে পারছে না। দুর্ভিক্ষ অবস্থার দিকে ওখানকার পরিস্থিতি এগিয়ে যাচ্ছে। চারদিক থেকে সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলকে জাতীয় দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি উঠছে তখন ত্রাণ সচিব ‘একটি ছাগলও মরেনি তাহলে কিসের দুর্যোগ’ বলে আন্দোলনকারীদের কটুক্তিমূলক ভাষায় মন্তব্য করছেন। যখন কি না প্রজাতন্ত্রের একজন সচিব এ ধরনের কথা বলেন তখন খুব জানতে ইচ্ছে করে, তিনি একজন দেশপ্রেমিক কি না। তিনি হাওরে এসে বলে গেছেন কোনো এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হলে সেখানকার ৫০ শতাংশ মানুষকে মারা যেতে হবে! তাহলে তিনি চাইছেন হাওরঞ্চলের ৫০ শতাংশ মানুষ মারা যাক? ৫০ শতাংশ মানুষকে মরে প্রমাণ করতে হবেÑ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেই কেবল জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণার দাবি রাখে! এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘জীবিত ও মৃত’র একটি বিখ্যাত উক্তি, ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই’ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল। স্বভাবতই সুনামগঞ্জের মানুষের এই চরম দুর্দিনে এমন অসংবেদনশীল কথা প্রচ- ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। সুনামগঞ্জের ২৫ লাখ মানুষ আজ লড়াই করে যাচ্ছে।
শুধু হাওর অঞ্চল নয়, উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতেও আমরা ফসলহানির খবর জানছি। অথচ জাতীয় দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অনেক বড় দুবর্লতা দৃশ্যমান। ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনা এ ধরনের জাতীয় দুর্যোগ সংকটকে মোকাবিলা করেছেন। সারাবিশ্বে তখন তিনি নন্দিত হয়েছিলেন। বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করতে সক্ষম। এখনো সেই একই প্রত্যাশা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বরাবরের মতো প্রধানমন্ত্রীকেই কি এগিয়ে আসতে হবে দুর্যোগ, সংকট মোকাবিলায়?
লেখক: কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান