ম্যাক্রোঁই কি ফ্রান্সের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট? ফ্রান্সে নির্বাচনকে ঘিরে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ
কামরুল আহসান : ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফা অনুষ্ঠিত হলো গতকাল। প্রত্যাশা যা ছিল তার অনেকটা কাছাকাছিই হলো ফলাফল। তবে বিস্ময় হচ্ছে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর উত্থান। মাত্র দু’বছরে গড়া রাজনৈতিক দল ‘এগিয়ে চলো’ নিয়ে তিনি এতোটা এগিয়ে যাবেন তা কেউ ভাবতে পারেনি। লি পেনকেও পেছনে ফেলে তিনি এগিয়ে গেলেন সবার সামনে।
৯৭ শতাংশ ভোট গণনায় ম্যাক্রোঁ পেয়েছেন ২৩.৯ শতাংশ আর লি পেন পেয়েছেন ২১.৪ শতাংশ। ফ্রাঁসোয়া ফিলন পেয়েছেন ১৯.৯ শতাংশ ভোট, জাঁ লুক ম্যালেঙ্কোঁ পেয়েছেন ১৯.৬ শতাংশ। সবচেয়ে ভরাডুবি হয়েছে বেনোয়াঁ হ্যামনের। মাত্র ৬.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি জনপ্রিয় ৪ জনের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে। দু’সপ্তাহ পর ৭ মে’র দ্বিতীয় রাউন্ডে যাচ্ছেন লি পেন আর ম্যাক্রোঁ। এখনো বহু হিসাব-নিকাশ বাকি। এই দু’সপ্তাহে অনেক কিছু উলট-পালট হয়ে যেতে পারে। বিদায়ী-প্রার্থীরা এখন কাকে ভোট দেন তাই দেখার বিষয়। সম্ভাবনার পাল্লা ম্যক্রোঁর দিকেই বেশি। কারণ পিছিয়ে পড়া দুই প্রধান দল বেনোয়াঁ হ্যামন এবং ফ্রাঁসোয়া ফিলন জানিয়ে দিয়েছেন তারা ম্যাক্রোঁর পক্ষে আছেন। আর যদি তা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই লি পেনের জন্য খারাপ খবর। কারণ, তার প্রধান বিরোধী বড় দল দুটোকেই ম্যাক্রোঁ টেনে নিচ্ছেন। ধরেই নেয়া যায় ম্যাক্রোঁই হচ্ছেন ফ্রান্সের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। সাবেক ফ্রাঁসোয়া ওলাদও ম্যাক্রোঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলও। সেই সঙ্গে ইউরোপীয় অন্যান্য নেতারাও তাদের সমর্থন জানিয়েছেন মধ্যপন্থী এই উদীয়মান নেতাকে।
নির্বাচনের আগেই লি পেনকে উদ্দেশ করে আইএমএফ’র প্রধান ক্রিস্টিয়ানা লেগার্দে মন্তব্য করেছেন, লি পেন প্রেসিডেন্ট হলে অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ভয়াবহ এক বিপর্যয় নেমে আসবে। লি পেনের উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাবের কারণেই তিনি এ কথা বলেন। পরোক্ষভাবে তার সমর্থন হয়তো ম্যাক্রোঁর প্রতিই। যদিও তিনি সরাসরি ম্যাক্রোঁকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলেননি। কিন্তু তারও সমর্থন ছিল বোধহয় ম্যাক্রোঁর প্রতিই।
কিন্তু, লি পেনের প্রতি সমর্থন ছিল বিশ্বের দুই শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প ও পুতিনের। সেটা হয়তো স্বাভাবিকই। কারণ তারা দুজনই কট্টর জাতীয়তাবাদী।
ম্যাক্রোঁ নির্বাচনি প্রচারণার সময়ই জানিয়েছিলেন, জাতীয়তাবাদ নিয়ে এতো বাড়াবাড়ির কিছু নেই। জাতীয়তাবাদই অনেক উগ্রতা ও যুদ্ধের কারণ। দর্শনের ছাত্র ম্যাক্রোঁ জাতীয়তাবাদের বিকারটা বুঝতে পেরেছিলেন অনেক আগেই। আর সাম্প্রতিক সময়ে দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের বিকারটাও তিনি লক্ষ্য করেছিলেন।
ম্যাক্রোঁ যা করলেন তা এক কথায় বিস্ময়করই বলা যায়। তাকে এখন বলা হচ্ছে বহিরাগত হয়েও রাজনৈতিক অঙ্গন জয় করা নেতা। কারণ অন্য প্রার্থীদের মতো তার পূর্বের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। এক সময় ছিলেন ব্যাংকে অর্থ বিনোয়োগকারী। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাদের সময় ছিলেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে তিনি কখনো নির্বাচনেও অংশ নেননি। হঠাৎ করেই ২০১৪ সালে তিনি নিজের দল ‘এল মার্সি’ বা ‘এগিয়ে চলো’ গঠন করেন। আর মাত্র দু’বছরে নিজের মধ্যপন্থি মনোভাবের কারণে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম স্থানে এগিয়ে থাকবেন তা ৬ মাস আগেও ভাবতে পারেনি কেউ। সবচেয়ে বড় কথা, ট্রাম্পের রক্ষণশীল রাজনীতির বিরুদ্ধেই তিনি এক প্রতিবাদ। ট্রাম্প সমর্থন জানিয়েছিলেন লি পেনকে। কারণ লি পেন অনেকটা ট্রাম্পপন্থি। ট্রাম্পের মতোই তিনি কিছু উত্তেজিত মতবাদ ছড়িয়ে ছিলেন নির্বাচনি প্রচারণায়। অভিবাসন ঠেকাবেন, প্রয়োজনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবেন। তার বিপরীতে ম্যাক্রোঁ অনেক সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বামপন্থি ও ডানপন্থিকে এক করে তিনি মধ্যপন্থি এক মনোভাব গড়ে তুলেছিলেন। যা পছন্দ করেছিলেন ফ্রান্সের তরুণ প্রজন্ম। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাকে সমর্থন জুগিয়েছিল। নিজের এই সাফল্যে ৩৯ বছর বয়সী এ তরুণ নেতা সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বিনয়ের সঙ্গে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, ‘জনগণের ভয়, অনিশ্চয়তা আর ক্ষোভের কথা আমি শুনতে পেয়েছি। আর সেই সাথে তাদের প্রত্যাশাও আমার মধ্য প্রকাশিত হয়েছে। বড় দল দুটোকে প্রত্যাখ্যানের মধ্যদিয়ে জনগণকে আমার উপর আস্থা রেখেছেন কারণ তাদের মনের চাওয়াগুলো আমার মধ্যে প্রতিফলিত হতে দেখেছেন।
নির্বাচনকে ঘিরে কিছু বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষেরও খবর পাওয়া গেছে। ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর ফিলন, হ্যামন, মেলেঙ্কোঁর অনেক সমর্থক লি পেন ও ম্যাক্রোঁর বিজয় মেনে নিতে পারেনি। তারা উত্তেজিত হয়ে কিছু ভাঙুর ও কয়েকটা গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছে। পুলিশ কয়েকজনকে সাময়িকভাবে আটকও করেছে। ঘটনাটি খুব বড় কিছু না হলেও ফ্রান্সের মতো গণতান্ত্রিক দেশে এমন সংঘর্ষের খবরে অনেকে আশ্চর্য হয়েছে।
সে যাই হোক, বাকি দু’সপ্তাহ কীভাবে পার হয় এখন সেটাই দেখার বিষয়। এখন সবাই তাকিয়ে আছে ৭ মে’র দিকে। হয়তো তারপর ম্যাক্রোঁর হাত ধরে সূচনা হতে যাচ্ছে এক নতুন ফ্রান্স, এক নতুন ইউরোপ, আর এক নতুন বিশ্বও।
সূত্র : ব্লুমবার্গ পলিটিক্স, গার্ডিয়ান, সিএনএএন, দ্য বিজনেস টাইমস, আরটি, বিবিসি