আইন সংশোধনের আহ্বান বিশিষ্টনাগরিকদের ১৮ বছরের নিচে বিয়ের সুযোগে বাল্যবিয়ে বাড়বে আশঙ্কাজনকহারে
উম্মুল ওয়ারা সুইটি : বাল্যবিবাহ আইনে মেয়েদের বিয়ের বয়স শিথিল করার বিষয়টি প্রকারান্তরে আইনগতভাবে বাল্য বিয়েকে স্বীকৃতি দেওয়া বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছেন, এমনিতেই নানা কারনে ছোট ছোট মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। অনেক সময় কিশোরী মেয়েরা প্রেমে জড়িয়ে বা ফাঁদে পড়ে বিয়ে করে ফেলে। সেগুলো সাধারণত সামাজিক সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়। আর এটি আইনের বিধানে যুক্ত করায়, বাল্য বিয়ে বাড়বে আশংকাজনক হারে।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ব্যাখ্যা সম্পর্কে বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা ঠিক আছে। কিন্তু আমরা চাই না এটা আইনে স্বীকৃত থাকুক। কারণ এখনো গ্রামের মেয়েদের ১৩ বছর বয়স থেকেই বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নেন অভিভাবকরা। এই আইন নারী শিক্ষার উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রধানমন্ত্রী অল্প বয়সের বিয়ে নিয়ে যেসব দেশের উদাহরণ দিয়েছেন সেসব দেশের প্রেক্ষাপট আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট এক নয় বলেও মন্তব্য করেন মানবাধিকার নেতারা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, এই আইন অপ্রাপ্তবয়সে বিয়েকে আরও উস্কে দেবে। এই আইনে ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ের সুযোগ থাকায় এরই মধ্যে গ্রামাঞ্চলে বাল্য বিয়ে বেড়ে গেছে। নানা ছুতোয় অভিভাবকরা মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের আইনে ছেলেদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ২১ আর মেয়েদের ১৮। নতুন আইনে বিয়ের এই বয়স ঠিক থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে আদালতে নির্দেশনা আর পিতা-মাতার অনুমোদন সাপেক্ষে ১৮ বছর বয়সের আগেও বিয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে।
এই আইনের খসড়া প্রণয়নের শুরু থেকেই বিয়ের বয়স কমানো নিয়ে কথা উঠে। নারী অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠন সরকারকে মেয়েদের বিয়ের বয়স না কমানোর অনুরোধ জানিয়ে আসছিল। কিন্তু তারপরও গত অধিবেশনে আইনটি পাশ হয়। এ নিয়ে একটি রিট আবেদন হয়। গত মঙ্গলবার রাতে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বিশিষ্টজনরা বিষয়টি বিবেচনা করতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।
নারী নেত্রী খুশি কবীর বলেন, কম বয়সে বিয়ে হলে মেয়েদের শরীর ও মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সারা জীবনেও তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয় না। আর কম বয়সের মায়ের সন্তানও ঝুঁকিতে থাকে। এই অবস্থায় সরকার আইনে মেয়েদের বিয়ের বয়স না কমালেও শর্তসাপেক্ষে সে সুযোগ রাখা উদ্বেগজনক। ১৮ নিচের মেয়েদের বিবাহ দেওয়া হলে বাল্য বিবাহ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাবে। আমাদের আশঙ্কা প্রতিটি ক্ষেত্রই বিশেষ ব্যবস্থার আওতায় পড়বে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এই আইন নারীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। পাশাপাশি ধর্ষন বাড়বে। আইনে এই বিশেষ সুযোগ বাদ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
জানা গেছে, এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর ব্যাখ্যার পর মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারক লিপি দেওয়া হবে।
সুলতানা কামাল বলেন, আইনটিতে আছে কোন কারণে যদি কিশোরী গর্ভধারণ করে তবে বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে বিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু কোনো মেয়ে ১২ থেকে ১৬ বছরের কিশোরী গর্ভধারণ করলে কী হবে? তিনি বলেন, শিথিল করা হলে বাল্য বিয়ে বন্ধের লড়াইয়ের পথে তা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে৷ এই আইন সারা দেশে অভিভাবকদের এই বার্তা দিয়েছে, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে সরকার বাল্য বিয়েকে যৌক্তিক মনে করছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী আয়শা খানম বলেন, আমরা আশা করেছিলাম, নতুন আইনটি পুরনো আইনের তুলনায় অনেক ভালো হবে। কিন্তু ঘটেছে উল্টো। আমরা প্রত্যাশা করি এই বিধান বাদ দেওয়া হবে। কোনো ধরণের সুযোগেই ১৮ বছরের নিচে বিয়েকে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারীবান্ধব এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য যিনি অনেক কিছু করেছেন। তাই তার কাছে প্রত্যাশা, তিনি এই আইনটি সংশোধন করবেন।
নারী নেত্রীরা ইউনিসেফ-এর পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি। ১৮ বছর বয়স হওয়া আগেই বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। আর আইনে এই সুযোগ থাকায় বাল্য বিয়ের হার আরও বাড়বে। সম্পাদনা-হুমায়ুন কবির খোকন