বানভাসি নগরবাসী, পানির তোড়ে ফিরে আসি
অরুণ কুমার বিশ^াস
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রথম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
ফেসবুকসূত্রে এক মজার তথ্য জানা গেল। তিলোত্তমা নগরী ঢাকায় নাকি উবার কোম্পানি ট্যাক্সি সার্ভিসের পাশাপাশি একটি নৌ-সার্ভিসও চালু করেছে এবং তার নাম দিয়েছে ‘কুবের নৌ-পরিবহন সার্ভিস। বলাবাহুল্য, উবারের লোকজন বাংলা সাহিত্যে ভাল জ্ঞান রাখেন। তারা অতি অবশ্যই শ্রদ্ধেয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটি পড়েছেন। সেই কুবের এখন মাছধরা বাদ দিয়ে মাঝিগিরি করছেন। বেকার থাকার চেয়ে নৌ-পারাপার মন্দ কী! তাছাড়া বিল-হাওরে মাছ নেই, কিন্তু নগরে বেশুমার পানি আছে। তাই নৌকার মাঝি হয়ে জনসেবা করা দেশপ্রেমের নামান্তর বৈকি!
আদতে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে মশকরা বা রম্যরচনা মানায় না। প্রকৃত সত্য এই যে, আমাদের প্রিয় ঢাকা শহর এখন পানিতে অবগাহন করছে। কোনো কোনো জায়গায় কোমর পানি নয়, রীতিমতো গলাসমান পানি জমেছে। হাঁটুপানি স্রেফ মামুলি ব্যাপার। পানির কারণে শান্তিনগরে এখন চরম অশান্তি বিদ্যমান। মৌচাকের মৌমাছি সব পানির ভয়ে ভেগেছে। মালিবাগে বাগান কোথায় যে মালিরা কাজ করবে! আরেকটু নেমে গিয়ে মুগদা, মা-া বা মাদারটেকের পরিস্থিতি দেখবেন আরও ভয়াবহ। সেখানে নৌকাই শুধু নয়, বহুতল জাহাজও ভাসছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলেন আরজু বেগম। বরাবর হেঁটেই যাতায়াত করেন, অল্প পথ তাই পায়েহাঁটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এখন কোমরপানি দাবড়ে আরজু যাবেন কি করে! অনেক মুলামুলি ঠেলাঠেলির পরে যদিও বা একজন রাজি হয়, কিন্তু রিকশাওয়ালার খাই বড় বেশি। অবস্থা বুঝে সে দুর্দান্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। দুকিলো পথ যেতে একশ টাকা হেঁকে বসলো রিকশাওয়ালা। কারণ রাস্তার করুণ দশা, তাও আবার পানিতে নিমজ্জিত।
অগত্যা রাজি হন আরজু বেগম। সাথে বাচ্চা, ওদিকে স্কুলের বেলা বয়ে যায়। দেরিতে গেলে গেট বন্ধু, বেহুদা ফিরে আসতে হবে। দুপা যেতে না যেতেই বেমক্কা টাল খায় রিকশা, চালকের দিব্যদৃষ্টি নেই যে পানির তলার ভাঙা রাস্তা সে দেখতে পাবে। টাল খেয়ে পড়ে যায় ত্রিচক্রযান। মেয়েকে নিয়ে আরজুও পানিতে ভরাডুবি। স্কুলে যাওয়া দূরে থাক, আচমকা পড়ে গিয়ে মেয়ে প্রচ- ভয় পায়, জুড়ে দেয় চিল-চিৎকার। বই ভিজে নষ্ট হয়। অন্তত দুদিন মেয়ে স্কুলে যেতে পারবে না।
এ শুধু একজন আরজুর কথা বললাম। এমন আরও অনেক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি এখন নগরবাসী। রাস্তা ভাঙা, সে এক বস্তু আছে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো অঝোরে ঝরেছে মেঘ। গত কুড়ি বছরে এই পরিমাণ বারিপাত আর কখনো হয়নি, আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে। তাছাড়া বারিধারায় ঝরলে হলে না হয় মানা যেত, নামেই কেমন বৃষ্টির ঘ্রাণ মিশে আছে। ওখানে রাস্তাঘাটও বেশ মজবুত, অতিথিপাড়া তাই পানিও দাঁড়াতে সাহস করে না বুঝি।
আমরা বোধ হয় ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি এখন। পানিতে সয়লাব সারা দেশ। ভেঙে গেছে বাঁধ তাই হাকালুকি হাওরে তলিয়েছে ধান, সেই পচা ধানের পাতায় বিষিয়েছে পানি, ফলে মারা গেছে মাছ। যেন ধ্বংসের নিগড়ে বাঁধা পড়েছে নগর ও দেশ।
বৃষ্টি তুমি অমন করো ঝরো না। গ্রীষ্মের প্রচ- দাবদাহে অতিষ্ঠ নগরবাসী, কিন্তু নোংরা কাদাপানির এমন অত্যাচার তো আমরা চাইনি! পানি জমা হচ্ছে, কিন্তু তা নিষ্কাশনের উপায় নেই। নগরবিদরা বলেন, এর মূল কারণ শহরের বেষ্টনির মাঝে যে খাল ও ডোবা সেসব ভরাট হয়েছে বিধায় বৃষ্টির পানি ধারণ করার মতো জায়গা আর নেই। সেই উদ্বৃত্ত পানি উঠে আসে রাস্তায়, মাঠে বা শপিংমলে। কেউ কেউ বাসা থেকেও বেরোতে পারেন না, কারণ বৃষ্টির পানি উঠে এসেছে মূল ফটকের কাছে।
উপোসী চাতক তাই আর বৃষ্টির জন্য মেঘের কাছে আকুতি জানায় না। বরং নগরবাসীর কষ্ট দেখে কেঁদে ওঠে চাতকের মন। এই ভেবে আকুল হয়Ñ আহা রে, বৃষ্টি কত দুর্ভোগ নিয়ে এলো মানুষের জন্য! এই রে, চোখের সামনে পা পিছলে পড়ে গেলেন এক অশীতিপর বৃদ্ধ। তিনি ভাবতেও পারেননি, পানির নিচে চোরাফাঁদের মতো খানাখন্দ মুখ লুকিয়ে আছে। নানা অজুহাতে নগরের রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি চলে। বিদ্যাৎ, গ্যাস, টেলিফোন, উন্নয়ন কাজÑ সব মিলিয়ে এই শহরের বুকে কতবার নিষ্ঠুর খননকাজ চলে তার ইয়ত্তা নেই। বোদ্ধারা বলেন, এর কারণ কাজে সমন্বয় নেই। আমার প্রশ্ন, সমস্যা যখন জানা গেছে, কর্তাব্যক্তিরা তাহলে সমাধানের পথ বাতলে দেয় না কেন! একটু মানিয়ে গুছিয়ে সমন্বিতভাবে উন্নয়নকাজ করলেই হয়!
কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে বলুন! আমরা আদার বেপারি, জাহাজের খবর কমই রাখি। শহরটা যে আমারও, তাই টুকটাক খবর এখন রাখতেই হয়। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র মহোদয় অবশ্য ওয়াসাকে একহাত নিলেন। অদক্ষতার একটা তকমাও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাতে অযাচিত পানির তোড় কি কিছু কমবে, নাকি বাচ্চামেয়েটা খুব শিগগিরই মনের আনন্দে স্কুলে যেতে পারবে!
সম্পাদনা: আশিক রহমান