বিএনপিকে বলিÑ মুখের বুলি নয়, দুহাত বাড়িয়ে হাওরে যান
ড. বদরুল হাসান কচি
হাওরাঞ্চল তথা সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ি ঢলের পানি এবং ভারি বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় ধানসহ কৃষিজাত ফসল প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ায় এতদঞ্চলের কৃষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ অঞ্চলের প্রধান ফসল বোরো ধান ও অন্যান্য ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। কাঁচা-পাকা ধান পানিতে পচে পানিদূষণজনিত কারণে মৎস্যসম্পদেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ক্ষতিটি কি রকম হয়েছে সেটি বোঝার জন্য আমরা যদি সরকারি হিসেবের দিকেও তাকাই তাহলেও হৃদয় কেঁপে ওঠে। সংবাদ সম্মেলনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব জানিয়েছেন, ‘বন্যায় দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। যেখান থেকে ছয় লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যেত।’ অপরদিকে মৎস্য অধিদফতর হাওরের পরিস্থিতি নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে এক প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘হাওরের পানিদূষণে প্রায় ৪১ কোটি টাকার ১ হাজার ২৭৬ টন মাছ মারা গেছে। এ ছাড়া মারা গেছে ৩ হাজার ৮৪৪টি হাঁস।’ কেন মারা গেল সে ব্যাখ্যায় অধিদফতর জানিয়েছে, ‘পানিতে অক্সিজেন একেবারেই কমে যাওয়া এবং অ্যামোনিয়া ও অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে মাছ মারা গেছে।’
এ যখন পরিস্থিতি তখন বিরোধী দল বিএনপি বলছে, ওই অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা হোক। আর সরকার থেকে বলা হচ্ছে, দুর্গত এলাকা ঘোষণার মতো পরিস্থিতি এখনো হয়নি, আমরা সব রকম উদ্যোগ নিয়ে হাওরবাসীর পাশে আছি। পাশে থাকার ঘোষণা থেকেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘বন্যাকবলিত এলাকার মানুষদের সহায়তায় সোমবার থেকে কর্মসূচি শুরু হবে। পরবর্তী একশ দিনের জন্য প্রত্যেক পরিবারকে মাসে ৩০ কেজি চাল এবং নগদ ৫শ টাকা দেওয়া হবে। ফলে এ কর্মসূচির আওতায় সুবিধা পাবেন ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবার। তবে সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।’
কিন্তু কথা হলো, একাধিকবার ক্ষমতায় থাকা বিএনপি কি কেবল সরকারের নিকট একটি ঘোষণার দাবি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবেন, নাকি তাদের আরও কিছু দায়িত্ব আছে? যে সকল এলাকাগুলোর মানুষ বন্যার পানিতে ভাসছে সে মানুষগুলোর কাছে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেননি কেন এখনো? অথচ এই মানুষগুলোর কাছে ভোট চাইতে কি যাননি অতীতে কিংবা আগামীতে যাবেন না? কে না জানে, এখনকার সময় স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় যেকোনো নির্বাচনে চূড়ান্ত মনোনয়ন প্রাপ্তরা অঢেল টাকার মালিক হন! তবে কি বিএনপি থেকে এমন কেউ নেই যারা স্ব-উদ্যোগে কিংবা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে ওই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পারে? মানুষের কল্যাণে সত্যি যদি কাজ করার ইচ্ছে থাকে তাহলে ক্ষমতার বাহিরে থেকেও কিছু কাজ করা যায়। কেবল মিডিয়ার সামনে মুখের বুলি নয়, দুহাত বাড়িয়ে হাওরে যান।
সরকারি আরেকটি উদ্যোগ প্রশংসনীয়। হাওর এলাকার কৃষকরা কম-বেশি প্রায় সকলেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কৃষিপণ্য উৎপাদন করেন। সে বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত হাওরে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ঋণ আদায় স্থগিত রাখার। পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমের (সিএসআর) আওতায় ওইসব এলাকার মানুষদের অতিদ্রুত আর্থিক সাহায্য ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণে সব ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, বন্যায় এমন পানি স্বাধীনতার পর আর দেখেননি। এবারের বন্যায় হাওর এলাকা ভেসে যাওয়ার মূল কারণ ছিল বাঁধগুলো ভেঙে পানি প্রবেশ করা। তাই স্বাভাবিকভাবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যও গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের সচিব বলেছেন, ‘হাওর এলাকায় বিদ্যমান বাঁধগুলো ষাটের দশকের পরিকল্পনায় করা। এবারের ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নেব বাঁধগুলো কী পরিমাণ উঁচু করা যায়।’ সচিব মহোদয়ের এ বক্তব্য থেকেই কিছু প্রশ্ন জন্ম নেয়; এ শিক্ষা নিতে কেন আমাদের কয়েক দশক সময় পার করতে হয়েছে? এ ধরনের ব্যাপক ক্ষতির মাধ্যমে শিক্ষা না নিয়ে নিজেদের বোধের উন্মেষ ঘটিয়ে আগেই কি আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল না? এ প্রশ্ন বর্তমান সরকারে যারা আছেন কেবল তাদের জন্য নয় বিগত সরকারগুলোকেও ইঙ্গিত করে।
যাইহোক, সবশেষে দেশের একটি শীর্ষ দৈনিক থেকে হাওর এলাকার ষাট-ঊর্ধ্ব এক কৃষকের ছোট একটি কথা দিয়ে শেষ করছি, ‘আমাদের তো আর কিছু নাই, আমরা যেন হাওরে মাছ ধরে বেঁচে থাকতে পারি। সরকার যেন হাওর বড়লোকদের লিজ না দেয়। লিজ দিলে আমরা মাছ ধরতে পারব না। আর মাছ ধরতে না পারলে আমরা না খেয়ে মরে যাব।’
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান