বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক : বন্ধুত্ব দিয়েই সবকিছু অর্জন করা সম্ভব
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ জন্মের মূল চেতনা হচ্ছে ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ সালে যারা সেই ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, তাদের পায়জামা পরা হিন্দু বলা হয়েছিল। কেবল তাই নয়, ভাষা আন্দোলনকারীদের ভারতের দালাল বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছিল। সে সময় এই সমস্ত মন্তব্য করেছিল পাকিস্তানের মুসলিম লীগ ও সমমনা রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। এমনকি ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে যারা ক্যাম্পেইন করেন, তাদেরকেও ভারতের দালাল বলা হতো। মূলত সেই সময় থেকে একটি গোষ্ঠী আমাদের সকল প্রগতিশীল কর্মকা-ের তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। এর অংশ হিসেবে রবীন্দ্র-সঙ্গীতসহ পহেলা বৈশাখের আয়োজনে বিধিনিষেধসহ নানাভাবে আঘাত হানা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে কেউ যদি মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলত, তখন তাদেরকে ভারতের দালাল বলা হতো। দীর্ঘদিন যাবৎ তা অব্যাহত ছিল। দেশি-বিদেশি স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ও পাকিস্তান এবং মুসলিম লীগ ঘরানার লোকজন সম্মিলিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। এর মাধ্যমে ’৭৫-এর পরবর্তী সময়ে ওই পাকিস্তানি ভাবধারার গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা কিংবা সরকার পরিবর্তন করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না। তাদের লক্ষ্য ছিল নতুন করে আবার পূর্ব পাকিস্তান কায়েম করা। সে সময় যারা সামরিক শাসক ছিল এবং তাদের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত হয়েছিল, তারা ছিল মুসলিম লীগের উত্তরাধিকারী। সেই তখন থেকে ভারত বিরোধিতা এবং অন্যদের ভারতের দালাল বলা ছাড়া তাদের আর কোনো রাজনীতি ছিল না। কিন্তু আমরা দেখেছি, তখন তারাই আবার ভারতের সঙ্গে চুক্তি করেছিল এবং নতজানু হয়ে কাজ করে। এখনো তাদের রাজনীতির মূল বিষয়ই হচ্ছে ভারত বিরোধিতা। বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তিস্তার পানি চুক্তি। এবার প্রধানমন্ত্রীর সফরে বিষয়টি সবার নজর কেড়েছে। তবে তিস্তার বিষয়ে সুষ্ঠু মীমাংসা না হওয়ায় অনেকে হতাশার কথা বলেন। আসলে হতাশা হলো প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার মধ্যকার ব্যবধান। এবার প্রধানমন্ত্রীর সফরে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না জানিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছিল, কিন্তু তারপরও তিস্তা নিয়ে এত প্রত্যাশার সৃষ্টি হলো কিভাবে? এর আগে মনমোহন সিংহের সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। সব ডকুমেন্ট প্রস্তুত ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এতে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল। তবে তিস্তা পানি সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। পানির ন্যায্য হিস্যা দিলেও এই সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ উজান থেকে পানি আনার ব্যবস্থা করেই তিস্তা চুক্তি করতে হবে। এছাড়াও তিস্তার সঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও রয়েছে। তবে এবার শেখ হাসিনার সফরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রায় ৬ বছর পর আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রাজ্য সরকারের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পাওনার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের মাঝে ঝামেলাপূর্ণ অনেক ইস্যু রয়েছে। কাজেই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো তিস্তা চুক্তিকে বিলম্বিত করছে। তবে চুক্তি জরুরি ভিত্তিতে হওয়া দরকার। এর আগেও আমরা দেখেছি, দুই দেশের ভৌগোলিক সীমানা চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রেও রাজ্য সরকারের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় আসতে হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। ইতোমধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের সরকারের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছে। পানির সমস্যা একটি ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা। কাজ একটাই হবে, তা হলো বন্ধুত্বের মাধ্যমে তিস্তা সমস্যার সমাধান করতে হবে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, ভারত তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ৮৫ শতাংশ পানি ব্যবহার করছে। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, হাওড়া থেকে দিল্লি যাওয়ার সময় আমি যত নদী দেখেছি, ব্রিজ, কালভার্ট পার হয়েছি, তার সবগুলো প্রায় শুকনো। কোথাও পানি নেই। আমেরিকাভিত্তিক ‘সেন্টার ফর অ্যাটমসফিয়ারিক রিসার্চে’র সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পৃথিবীর ৯২৫টি নদীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশের পানি কমে গেছে। এর মধ্যে ২১৪টি আন্তর্জাতিক নদীর অনেকগুলোই রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পানির সমস্যা রয়েছে, একই সমস্যা ভারতের সঙ্গে চীনের। কাজেই বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশের পানি সমস্যা সীমাবদ্ধ নেই। এখন চীনসহ ত্রি-দেশীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আশা রাখা যায়, দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের আলোকে শেখ হাসিনার আমলেই তিস্তা সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে আমরা উপনীত হতে পারব। তবে এর আগেও জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা সরকার ছিল। সে সময়ও তিস্তা সমস্যা ছিল। কিন্তু সমাধান হয়নি এবং কোনো প্রচেষ্টাও চালানো হয়নি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও কোনো ভৌগোলিক সীমানা ছিল না। এটা ছিল অত্যন্ত আতঙ্ক এবং ভয়ের ব্যাপার। একটি স্বাধীন দেশের ভৌগোলিক এবং সামুদ্রিক সীমারেখা থাকা বাঞ্চনীয় এবং সার্বভৌমত্ব দেশের অন্যতম অনুষঙ্গ। স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘদিন পর শেখ হাসিনা এবং মোদি সরকারের আমলেই আমরা স্বাধীন দেশের একটি পরিপূর্ণ মানচিত্র পেয়েছি। যা স্বাধীন দেশের অন্যতম স্বীকৃতি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক প্রবাহমান নদীর মতো। প্রধানমন্ত্রী প্রবাহমান নদী বলতে হয়তো একটি স্রোতধারাকে বুঝিয়েছেন। দুই দেশের এই সম্পর্ক অব্যাহত প্রক্রিয়া। যা নদীর মতো বহমান। তবে নদীতে আবার জোয়ার-ভাটার বিষয় থাকে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অনেক জোয়ার-ভাটা আমরা দেখেছি। সেই জোয়ার-ভাটার কারণে দুই দেশের সম্পর্ক এক সময় তিক্ততায় পরিণত হয়। জোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকারীদের জন্য ১০ ট্রাক অস্ত্র যাচ্ছিল। বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে এই সব কর্মকা-ের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের ব্যাপারে কেবল জটিল ইস্যুগুলোকে সামনে না এনে এ ধরনের ঘটনাকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখতে হবে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে আপ-ডাউনের বিষয় রয়েছে। বর্তমানে আমরা দুইদেশের মাঝে জোয়ারের সম্পর্কের মধ্যে আছি। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে ভালো। তবে এ সম্পর্ককে আরও গতিশীল করার জন্য বিতর্কিত ইস্যুগুলো সমাধান হওয়া দরকার। সমস্যাগুলোকে জিইয়ে রেখে তা বারবার ব্যবহার করাই ছিল বিগত মুসলিম লীগ ধাঁচের সরকারগুলোর মূল উদ্দেশ্য। দুই দেশের মধ্যকার সমস্যা সংক্রান্ত যে সব খবরাখবর পত্র-পত্রিকায় এসেছে, সেগুলো নিশ্চিত করে বলা যায় না, সবই সঠিক। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যারা সামরিক সরকার ছিল, তারা প্রত্যেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার চেষ্টা করেছে। ভারত যা যা চেয়েছে তারা সেভাবে কাজ করেছে। ভারতের সমর্থন ছাড়া হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দীর্ঘসময় ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারতেন না। কিন্তু এতে কিছুই পাওয়া যায়নি মাঝে মাঝে ভারত বিরোধিতার ভান ছাড়া। ভারতে যেমন বাংলাদেশ-বিরোধী পক্ষ আছে আবার বাংলাদেশেও ভারত-বিরোধী পক্ষ রয়েছে। কাজেই দুই দেশের ওই সব বিরোধীপক্ষের সমস্ত লেখালেখি প্রায় একই। চলবে-০১
সম্পাদনা: আশিক রহমান