অতিসংস্কারের কবলে বাংলা বানান
ড. সা’দত হুসাইন
ছাত্রজীবনে যে বানান শিখেছিলাম তার অনেক-গুলোই এখন যেন অচল হয়ে গিয়েছে। নতুন ধাঁচের বানান এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাট-কাট করা নতুন চেহারার শব্দ তার জায়গা দখল করে নিয়েছে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে দুঃখী হচ্ছে ‘ঈ’ কার, ‘উ’ কার এবং ‘ঐ’ কার। ছাপানো পাতা থেকে এরা আস্তে আস্তে ছিটকে পড়ছে। কদিন আগে দেখলাম একটি দৈনিক চীন দেশকে ‘চিন’ বানিয়ে ফেলেছে। পরে মনে হয় এ ব্যাপারে আর বেশি এগোয়নি। তবে একটি দৈনিকে কোম্পানি শব্দটি ‘কম্পানী’ হয়ে থিতু হয়ে গেছে।
বানানের নতুন ধারা মূলত এসেছে বাংলা একাডেমির অভিধান থেকে। এ ধারাকে বাস্তবে এগিয়ে নেয় নতুন প্রজন্মের দৈনিকসমূহ। এর প্রভাবে ‘শ্রেণী’ হয়ে গেল শ্রেণি, ‘দেশী’ হয়ে গেল দেশি, ‘সরকারী’ হয়ে গেল ‘সরকারি’। অ আকার খসে ‘আভ্যন্তরিণ’ অবশ্য আগেই ‘অভ্যন্তরীন’ হয়ে গিয়েছিল। মাটি কামড়ে নিজের অবয়ব ধরে রেখেছে শারীরিক, আন্তর্জাতিক, নদী, নারী এবং স্ত্রীর মতো শব্দগুলো। সমস্যা রয়ে গেছে ভয়ংকর (ভয়ঙ্কর), আতংক (আতঙ্ক), শব্দগুলো নিয়ে। এক্ষেত্রে দুধরনের বানানই দেখা যায়। কম্পিউটার কম্পোজে (ঙ্ক) হিসাবে যে যুক্তাক্ষরটি আসে, ছোট বয়সে এ চেহারার যুক্তাক্ষর আমরা দেখছি বলে মনে হয় না।
নতুন ধারায় ‘মত’, ‘ভাল’ শব্দগুলো ‘মতো’ ‘ভালো’ হয়ে গেল। প্রুফ-রিডার আমার এক লেখায় যেখানে এ শব্দগুলো ছিল, সব জায়গায় ‘ও’ কার লাগিয়ে আধুনিক বানানে আমার লেখা ভরে দিল। জনতার ‘মত’ হয়ে গেল জনতার ‘মতো’ এস এম হল হয়ে গেল এস এম হলো। আরও মজার ব্যাপার মালপত্র রূপান্তরিত হলো ‘মালো পত্র’ হিসাবে। আবুল মাল হয়ে গেল আবুল মালো, ভুল-ভাল গিয়ে দাঁড়াল ভুল-ভালো হিসাবে। সব মিলে একটা জগা-খিচুড়ি অবস্থা।
এখন আমরা ‘কাহিনী আর বাহিনীর বানান নিয়ে হাবু-ডুবু খাচ্ছি। ‘ঈ’ কারটি ফেলে ‘ই’ কার করার চেষ্টা চলছে। আমার ধারণা ‘ঈ’ কার হেরে গিয়ে বিদায় নেবে। তবে জ্ঞানী-গুণীরা ‘ঈ’ কার ছাড়তে রাজি নন। ‘কী’ শব্দটি নতুনভাবে ‘ঈ’ কার এর গলায় মালা পরিয়েছে। প্রশ্নবোধক চিহ্নের (?) পাশে ‘কি’ অথবা ‘কী’ কোনটি বসবে এ নিয়ে এখনও ধাক্কা-ধাক্কি চলছে। ‘কী’ হবে এর পরিণাম এখনও তা বোঝা যাচ্ছে না। আপাতত ‘কী’ এর দিকে পাল্লা ভারী। এদিকে বসার স্থান হারিয়ে শুধু ‘দুঃখ’ নিয়ে মন ভারী করে আছে বিসর্গ (ঃ); হারিয়ে যাওয়া স্থান বোধহয় বেচারা আর ফিরে পাবে না।
পুরানো প-িতরা অনেকেই এখনও আগের বানানেই শব্দ গঠন করেন। প্রুফ- রিডাররা তাদের বানান শুদ্ধ করে আত্ম-তৃপ্তি অনুভব করে। নতুন ধারায় চলতে গিয়ে আমি অনেক বানান বদলে ফেলেছি। তবে এখনও পুরোপুরি ধাতস্থ হতে পারিনি। আশা করি নতুন ধারার লোকেরা আমাদের ‘ভুল-ভাল’ এবং ‘মত’ কে ‘ভাল’ চোখে দেখবে। আমরাও শিক্ষিত। তবে পুরান ডিজাইনের। এই যা।
লেখক: সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান