জগন্নাথদেব ও জগন্নাথ মন্দির
ডেক্স রিপোর্ট : পুরীর জগন্নাথ মন্দির ভারতের অন্যতম প্রসিদ্ধ মন্দির। জগন্নাথ-আরাধনার ইতিবৃত্ত এতই প্রাচীন যে এর কোনো ঐতিহাসিক রেকর্ড পাওয়া সম্ভব নয়। জগন্নাথ মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কলিঙ্গ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মন্দিরটি শ্রীমন্দির নামে সমধিক পরিচিত। মূল মন্দির বা গর্ভগৃহের মাথায় রয়েছে একটি সুউচ্চ শিখর বা চূড়া। প্রদীপ উৎসর্গের জন্য রয়েছে ফসিল হয়ে যাওয়া কাঠের একটি স্তম্ভ। মন্দিরের সিংহদ্বারের রক্ষক দেবতা জয়া ও বিজয়া। মূল প্রবেশপথের সামনে রয়েছে অরুণস্তম্ভ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। খুরদার রাজা কোনোার্কের সূর্যমন্দির থেকে এটি নিয়ে আসেন।
জগন্নাথদেবকে কেন্দ্র করে একটি জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, কৃষ্ণ তার ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখ- দিয়ে তার মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। মূর্তিনির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী তার সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন সময় চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তার কাজে বাধা না দেন। বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় কাজ। রাজা ও রানিসহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তারা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন এবং শুনতে পেতেন ভিতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। ৬-৭ দিন বাদে যখন রাজা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রানি কৌতূহলো সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। দেখেন মূর্তি তখনো অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কাজে বাধাদানের জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। তখন দেবর্ষি নারদ তার সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত¡না দিয়ে বলেন এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ।
জগন্নাথের সবচেয়ে বিখ্যাত উৎসবটি হলো রথযাত্রা। এই উৎসবের সময় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি মূল মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বের করে এনে কাঠের তৈরি তিনটি বিরাট রথে করে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে গু-িচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। ভক্তরাই এই রথগুলো টেনে নিয়ে যান। যেখানেই জগন্নাথ মন্দির আছে, সেখানেই এই ধরনের রথযাত্রা আয়োজিত হয়
‘জগন্নাথ’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘জগত বা ব্রহ্মা-ের প্রভু’।
জগন্নাথ মন্দিরে ভক্তদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথা কখনই ছিল না। হিন্দুধর্মের সকল সম্প্রদায়ে জগন্নাথের পূজা হয়। তিনি শুধু বৈষ্ণব দেবতা নন, সকল সম্প্রদায়ের দেবতা। জগন্নাথকে তান্ত্রিক ক্রিয়ার সার মনে করা হয়। শৈব ও শাক্তরা জগন্নাথকে দেবী বিমলার ভৈরব অর্থাৎ শিব মনে করেন। এমনকি জগন্নাথ মন্দিরের পূজারিরাও শাক্ত সম্প্রদায়ভুক্ত। যদিও এই মন্দিরে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। বলরামকেও শিব ও সুভদ্রাকে দুর্গা মনে করা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, ভক্তদের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য জগন্নাথ যে কোনো দেবতার রূপ ধরতে পারেন। ভাগবত পুরাণে আছে, ঋষি মার্ক-েয় পুরুষোত্তম জগন্নাথ ও শিবের একত্ব প্রমাণ করেন। মহারাষ্ট্রের গণপতি ভট্ট হাতিবেশের সময় জগন্নাথকে গণেশ রূপে পূজা করেছিলেন
জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করার প্রধান কয়েকটি নিয়ম…
শ্রীক্ষেত্র পুরী। হিন্দু ধর্ম মতোাবলম্বী মানুষের অধিকাংশের বিশ্বাস, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে পূজো দেওয়া মানে সব তীর্থক্ষেত্র ভ্রমণের সমান পুণ্য।
এই মন্দিরে কিছু কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। আর তা ভাঙা হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে অত্যন্ত কড়া মনোভাব দেখায় মন্দির কর্তৃপক্ষ। দেখে নেওয়া যাক প্রধান কয়েকটি নিয়মÑ
হিন্দু ধর্মালম্বী ছাড়া কেউ মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেন না। এই কথা মন্দিরের সিংহদ্বারেই লেখা রয়েছে। ২. কোনো প্রকার চামরার সামগ্রী নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করা যায় না। ৩. মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, ছাতা, রেডিও মন্দিরের ভিতরে নেওয়া যায় না। ৪. কোনো রকম খাবার দাবার বা নেশার সামগ্রী নিয়ে মন্দিরে ঢোকা নিষিদ্ধ। ৫. মন্দিরের ভিতরে ধূমপান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ৬. কোনো রকম কোনো অস্ত্র নিয়ে জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করা যায় না।