ব্রহ্মার পুত্র মনু থেকে মানবজাতি
শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী
শ্রীমদ্ভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধের প্রথম অধ্যায়ে ব্রহ্মার পুত্র, মনুষ্যজাতির আদি পুরুষ, চতুর্দশ মনুর অন্যতম, ধর্মশাস্ত্রবক্তা স্বায়ম্ভুব মনুর তিন কন্যা এবং তাদের বংশাবলীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সেই তিন কন্যা ছিলেন আকূতি, দেবাহূতি এবং প্রসূতি।
প্রথম কন্যা আকূতির দুই কন্যা ছিল, তা সত্ত্বেও রাজা স্বায়ম্ভুব মনু তাকে প্রজাপতি রুচির হস্তে সম্প্রদান করেছিলেন এই শর্তে যে, ঐ কন্যার গর্ভে যে পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করবে, তাকে মনুর পুত্ররূপে মনুকে প্রত্যর্পণ করতে হবে। স্বায়ম্ভুব মনু তার পতœী রাণী শতরূপার পরামর্শক্রমেই এই ব্যবস্থা করেছিলেন।
শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ এই ব্যবস্থার তাৎপর্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুত্রহীন মানুষ তার কন্যাকে এই শর্তে সম্প্রদান করে থাকেন, যাতে তার পৌত্ররূপে ঐ কন্যার গর্ভজাত পুত্রটিকে তার পুত্ররূপেই গ্রহণ করে তার সম্পত্তির অধিকার দিতে পারেন। একে বলা হয় পুত্রিকা-ধর্ম, অর্থাৎ ধর্মীয় যাগযজ্ঞাদি সহকারে নিজপুত্র ছাড়াও অন্যজনের পুত্রকে গ্রহণ করা যায়।
কিন্তু এখানে আমরা মনুর অসাধারণ ব্যবস্থা লক্ষ্য করছি যে, তার দুই পুত্র বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তিনি তার প্রথমা কন্যাকে প্রজাপতি রুচির হস্তে সম্প্রদান করেছিলেন এই শর্তে যে, তার কন্যার গর্ভজাত পুত্রটিকে তারই পুত্রস্বরূপ প্রত্যর্পণ করতে হবে।
শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর এ প্রসঙ্গে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, রাজা মনু জানতেন, পরম পুরুষোত্তম ভগবান স্বয়ং পুত্ররূপে আকূতির গর্ভে আবির্ভূত হবেন, কারণ তিনি ভগবানের কাছে অভিলাষ করেছিলেন যেন ভগবানকে তার পুত্র এবং পৌত্ররূপে পেতে পারেন।
মনু মানবজাতির আদি আইন-প্রণেতা এবং তিনিই স্বয়ং যেহেতু পুত্রিকা-ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন, তাই আমরা মেনে নিতে পারি যে, মানব জাতিও সেই প্রথা গ্রহণ করেছিল। তাই, কারো নিজ পুত্র থাকলেও, নিজ কন্যার গর্ভে বিশেষ কোনো পুত্রলাভের অভিলাষ পূরণের উদ্দেশ্যে, আপন কন্যাকে সেই শর্তে সম্প্রদান করতেও পারেন। শ্রীল জীব গোস্বামীরও সেই অভিমত।
সংস্কৃত ‘মানব’ কথাটি এসেছে ‘মনু’ থেকে। মনুর সন্তান-সন্ততিদের নিয়েই মানবজাতি গড়ে উঠেছে। পিতার নামানুসারেই বৈদিক নিয়মে পুত্রের নামকরণ হয়। মনুর পুত্রেরা মানব, দনুর পুত্রেরা দানব, দিতির পুত্রেরা দৈত্য, এমনি।
মানবজাতির পিতাকে সৃষ্টি করেন সৃষ্টির প্রথম জীব ব্রহ্মা তার মানস শক্তি বলে। সমস্ত মুনিঋষি এবং দেবতাদের এভাবেই ব্রহ্মা সৃষ্টি করেছিলেন এবং চতুর্দশ মনুদেরও জীব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ঐ একইভাবে সৃষ্টি করেছিলেন তার মানস ইচ্ছাবলে।
অবশ্য পিতা ও মাতার দৈহিক মিলনের ফলে জীব সৃষ্টির প্রথম রীতি শুরু করেছিলেন স্বায়ম্ভুব মনু এবং তার পতœী শতরূপা। পিতামহ ব্রহ্মার দক্ষিণ পার্শ্ব থেকে সৃষ্টি হয়েছিলেন স্বায়ম্ভুব মনু এবং ব্রহ্মার বাম পার্শ্ব থেকে মানসবলে উদ্ভূতা হন শতরূপা। তারাই মানবজাতির জন্ম দিতে শুরু করেন।
প্রথমে মনু যখন শতরূপার সাথে দৈহিক মিলনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসেন, তখন শতরূপা অত্যন্ত লজ্জাবোধ করেছিলেন এবং বিব্রত হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, আমরা একই পিতার দেহ থেকে উদ্ভূত হয়েছি এবং সে সূত্রে আমরা ভাই-বোন, কিন্তু তিনি আমার সাথে দেহমিলন করতে চাইছেন।
তখন শতরূপা তার ইচ্ছাবলে নিজের দেহের রূপ পরিবর্তন করেন, তারপর দেহমিলনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির সন্তান-সন্ততির সৃষ্টি করেছিলেন। শতরূপা শত শত রূপ ধারণ করতে পারতেন।
তবে মনুর বংশ রূপে প্রথমে মানবজাতিরই সৃষ্টি হয়েছিল। ইংরেজিতে ‘ম্যান’ কথাটিও ‘মনু’ নামের সঙ্গে সাদৃশ্য রক্ষা করছে দেখা যায়। শুধু ইংরেজি ভাষাতেই নয়, ইউরোপীয় অনেক ভাষাতেও ‘ম্যান’ বা মানুষ কথাটির প্রতিশব্দের সাথে ‘মনু’ শব্দটির সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজ মানুষ তার আদি জন্মসূত্রের ইতিবৃত্ত হারিয়ে ফেলেছে বলেই জানে না এবং মানে না যে, তারা সকলেই প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মার সন্তান।
এই জন্মসূত্র স্বীকার করলে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, সমস্ত মানুষ আদিকাল থেকেই পরস্পরের সাথে কতখানি নিবিড়ভাবে আত্মীয়তার সম্পর্কে বদ্ধ। বৈদিক সংস্কৃতি সভ্যতার মূল শাস্ত্রসম্ভারের এটাই হলো বিস্ময়কর অবদান। কারণ এসমস্ত ভাগবতাদি শাস্ত্রাদির মধ্যে আমরা যতই অবগাহন করি, যতই পুরাকালের ইতিবৃত্ত অনুধাবন করি, ততই এমন একটি শুদ্ধ মনোভঙ্গি গড়ে ওঠে, যাতে ক্রমশই আমরা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে থাকি যে, আমরা প্রত্যেকেই, এই গ্রহলোকের প্রতিটি জীবই বাস্তবিক পরস্পরের সাথে কত গভীর আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িত এবং চরম অনুসন্ধানে আমরা আমাদের চিন্ময় সত্তার উপলব্ধি অর্জন করে বুঝতে পারি যে, আমরা সকলেই চিন্ময় আত্মা। আমরা সকলেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্নাংশ। এভাবেই কৃষ্ণভাবনার মাধ্যমে পৃথিবীতে মানবজাতির ভাবধারায় চিন্ময় ঐক্য, মৈত্রী এবং সৌহার্দ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাই আজ বিশ্বব্যাপী কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের এত জয়জয়কার।
সংস্কৃতে একটি প্রবাদ বাক্য খুবই জনপ্রিয়, তা হলো ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’। ‘বসুধা’ মানে এ বসুন্ধরা, পৃথিবী। ‘কুটুম্বকম্’ মানে আত্মীয়স্বজন। এই পৃথিবীর প্রতিটি জীবই পরস্পরের আত্মীয়স্বরূপ। কেবল মানুষই নয়, জীবজন্তু সকলেও তা-ই। কারণ আমরা সকলেই একই পিতামহ ব্রহ্মা এবং তারই মানসপুত্র মনুর বংশধর। এছাড়া আরো একটি গভীর তাৎপর্য রয়েছে। সেই গভীর তাৎপর্যটি হলো এই যে, আমরা সকলেই এ দেহগুলো নই, আমরা হলাম চিন্ময় সত্ত্বা এবং প্রত্যেকেই এক পরম চিন্ময় সত্ত্বা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সৃষ্টি। সেই বিবেচনা থেকেও আমরা সকল জীবই পরস্পরের সাথে পরম আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ শাশ্বত কাল যাবৎ। এ উপলব্ধি যতই মানুষের অন্তরে আমরা পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারব, বসুন্ধরায় শান্তি মৈত্রী ততই সহজ হবে।
কিন্তু আজ কী চলছে সভ্যতার নামে? মৈত্রীর নামে হানাহানি আর বিদ্বেষ। এটা কলির প্রভাব। কলিযুগের এ বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি থেকে মানবসন্তান ার মাধ্যমেই আজ আমরা সমগ্র জগতের জীবকুলকে যথার্থ মৈত্রীভাবে উদ্বুদ্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছি। এই সংকীর্তন আন্দোলনের সাহায্যেই কলির বিভ্রান্তিকর প্রভাব দুর হয়ে যাবেই যাবে এবং সমগ্র বিশ্ব একই সূত্রে আবার গাঁথা হয়ে যাবে। সেই ভবিষ্যদ্বাণী স্বয়ং শ্রীচৈতন্য মহপ্রভু করে গেছেনÑ পৃথিবীতে অছে যত নগরাদি গ্রাম / সর্বত্র প্রচার হইবে মোর নাম ॥ সকল নগরাদি গ্রামে কৃষ্ণকথা প্রচারিত হয়ে যাবে।
প্রায় শতবর্ষ পূর্বে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরও বলেছিলেন, এমন একদিন আসবে, যখন বিশ্বের সকল ধর্মমত সংকীর্তন আন্দোলনের ধারা বেয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর চরণপদ্মে এসে মাথা নত করে একতাবদ্ধ হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী তিনি ১৮৯৬ সাল নাগাদ করেছিলেন এবং তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিতও হয়েছে।
আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সফলতার অভিমুখে এগিয়ে চলছে। এখনো হয়ত জগতে সর্বজাতি সর্বধর্মের মিলন ঘটেনি, কিন্তু ইস্কনের মধ্যে তা সুস্পষ্টভাবে সার্থক সম্ভব হয়ে উঠছে। ইস্কনে বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সবাই এক সনাতন ধর্মের কাছে এসে মিলিত হয়েছেনÑ মিলিত হয়েছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সংকীর্তন আন্দোলনের ছত্রছায়ায়।
এখন, যদি কোনো একটি নীতিসূত্র কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে সুফল দেখায়, আর সেই ক্ষেত্রটিকে যদি আমরা ক্রমেই প্রসারিত করতে থাকি, তাহলে সেই একই নীতিসূত্র একই সুফল অবশ্যই সৃষ্টি করতে থাকবে প্রসারিত প্রয়োগক্ষেত্রে।
কৃষ্ণভাবনামৃত আস্বাদনের মাধ্যমে ইস্কনের ক্ষেত্রপরিধির মধ্যে যদি এমন অভূতপূর্ব একতা আর মৈত্রী বন্ধন সৃষ্টি হতে পারে এবং কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন সারা পৃথিবীর প্রতিটি নগরাদি গ্রামে প্রসারিত হয়ে যেতে থাকলে, সকল দেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ অবশ্যই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শ্রীপাদপদ্মে এসে মিলিত হবেই।
শ্রীল প্রভুপাদ বিশ্বব্যাপী যে চমৎকার বিপুল আয়োজন সূচনা করে রেখেছেন, তা বৃথা যাবে না। তার আয়োজনের মাধ্যমে, তার আবির্ভাব শতবার্ষিকীর প্রাক্কালেই পৃথিবীতে সংকীর্তন যজ্ঞের প্রসারের ফলে যথার্থ শান্তির বার্তাবরণ গড়ে উঠবে। এই কলিযুগেই সত্যযুগের উন্মেষ ঘটবে। সারা পৃথিবীতে সবাই যথার্থ ধর্ম-ভাবে অনুপ্রাণিত হবে এবং হয়ে উঠবে প্রকৃতই ভগবদ্ভক্তি অভিমুখী।
লেখক : ইস্কন জিবিসি ও আচার্য