সুজলা বাংলার ফুল, হিজল
মাহফুজ জুয়েল
‘ফোটে ফুল গভীর রাতে ঝরে পড়ে ভোর প্রভাতে
হিজল ফুলের নেশা ঘ্রাণ পারে গো ঘোর লাগাতে…’
হ্যাঁ, হিজল ফুল গভীর রাতে ফোটে। ভোরবেলায় ঝরে পড়ে। এর এক ধরনের মিষ্টি মাদকতাময় ঘ্রাণ আছে। হিজল গাছের কাছে গেলেই ওই ঘ্রাণ নাকে ঢোকে। আর যার ঢুকে সে-ই টের পায় সেই ঘোর! আহা কী মিষ্টি, কী মধু! এ কারণেই হিজল গাছে এত গুঞ্জনÑ মৌমাছির! জীবনানন্দকে দুদ- শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন, আর আমাকে সেদিন সারাদিন শান্তি দিয়েছিল এই হিজল। সত্যি বলছি। এই পয়লা বৈশাখের ছুটিতে গ্রামে চলে গেলাম। কুমিল্লার চান্দিনার হোসেনপুর গ্রাম। নাগরিক মনের ময়লা দূর করতে অনিয়ম করে একদিন ভোর বেলায় উঠলাম। মায়া-সবুজে ঘেরা চারপাশের পরিবেশ-প্রকৃতি। সতেজ হিম হিম হাওয়া। সঙ্গী গ্রামের এক বাল্যবন্ধু এবং তার শিশুপুত্র। হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় গিয়ে দেখি এক মনমাতানো চোখজুড়ানো দৃশ্য। একটি হিজল গাছের নিচে খুব মনোযোগ দিয়ে বেশ কয়েকজন শিশু ফুল তুলছে। দেখেই মনে হলো, প্রকৃতির টানেই প্রকৃতির কাছে ছুটে যায় প্রকৃতির সন্তান। ওই ভোর বেলায় নিশ্চয়ই শিশুদের মা-বাবা বা পরিবারের কেউ বলে দেয়নি যে, যাও হিজলতলায় গিয়ে ফুল কুড়াও! মালা গেঁথে গলায় দাও! শিশুরা নিজ থেকেই যে যার মতো খুঁজে নিয়েছে এবং ছুটে গিয়েছে ওই হিজলতলায়। ঠিক এভাবে আমরাও ছোটবেলায় ছুটে যেতাম ফুলের কাছে। ফলের কাছে। প্রকৃতির কাছে।
দূর থেকেই ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। পরে কাছে গেলাম। হিজল ফুল আর ওই ফুলখুকীদের হাসি দেখে প্রাণ ভরে গেল। কী যে ভালো লাগল আমার সেই সকাল বেলা! হিজল ফুল দেখতে খুবই সুন্দর। হিজলের লাল টুকটুকে রঙটাই আমার পছন্দ এবং অবশ্যই পুকুর বা খালের জলে ভাসা। কিন্তু এই হিজলের রঙটা একটু অন্যরকম। অনেকটা হলুদ বা সোনালি ধরনের। হিজল ফুল ফোটে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। হালকা গোলাপি রঙের ১০-১২ সেমি লম্বা পুষ্পদ-ের মাঝে অসংখ্য ফুল ঝুলন্ত অবস্থায় ফোটে।
জসীম উদ্দীন-এর ‘রাখালী’ কবিতায় রাখাল ছেলে প্রেয়সীকে বলে: কলমী ফুলের নোলক দেব, হিজল ফুলের দেব মালা, মেঠো বাঁশি বাজিয়ে তোমায় ঘুম পাড়াব, গাঁয়ের বালা! হিজল-এর নামের সঙ্গেই ‘জল’ আছে। নামসূত্রেই বোঝা যায়, সে জলজ গাছ। জলের সঙ্গে তার জীবন জড়িত। হিজলের আরও দুটো নাম: জলন্ত এবং নদীক্রান্ত। এই দুই নামের মধ্যেও জলের অস্তিত্ব জ্বলন্ত। হিজলের বৈজ্ঞানিক নাম: ব্যারিংটোনিয়া অ্যাকুট্যাংগুলা। এই নামের মধ্যেও ‘অ্যাকু’ মানে জল আছে। হিজলের সংস্কৃত নাম নিচুল। ধারণা করছি, মানুষের চুলের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ লম্বা ঝুলন্ত মঞ্জরির কারণে ওই নামকরণ। হিজলের ইংরেজি নাম ইন্ডিয়ান ওক।
হিজলগাছের প্রাণশক্তি প্রবল। বন্যার পানি কিংবা তীব্র খরাতেও টিকে থাকে। এমনকি পানির নিচে কয়েক মাস নিমজ্জিত থাকলেও হিজলগাছ বেঁচে থাকে। তাই হাওর অঞ্চলে এ গাছের ডাল মাছের অভয়রাণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। হিজল চিরসবুজ বৃক্ষ। মাঝারি আকারের ডালপালা ছড়ানো দীর্ঘজীবী গাছ। বাকল ঘনছাই রঙের ও পুরু। পাতা বড়, চামড়ার মতো মসৃণ। শাখার আগায় লম্বা ঝুলন্ত মঞ্জরি, ফুল ছোট। ফল ৩-৪ সেমি লম্বা, চার শিরযুক্ত। গাছটি প্রধানত বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে জন্মায়। কাঠ গোলাপি থেকে লালচে-ধূসর, মাঝারি শক্ত, টেকসই এবং আলমারি, নৌকা, আসবাবপত্র ও রেলকামরার অভ্যন্তরীণ সজ্জায় ব্যবহৃত হয়। হিজলের বাকল ও ফল বিরেচক এবং ডায়রিয়া ও নাকের ক্ষতে উপকারি। হিজলের বিষাক্ত অংশ হলো ফল, যা মারাত্মক বমনকারক।
লেখক: সাংবাদিক, লেখক ও আন্দোলনকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান