শিশুদের বীরত্বে স্বীকৃতি নয় কেন?
মঞ্জুরুল আলম পান্না
রাজধানীর আগারগাঁও-এ মাত্র কদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবনের। এই জাদুঘর তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ১০২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকারের অনুদান ৪০ কোটি টাকা। আর বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া গেছে প্রায় ২৬ কোটি টাকা। বাকি টাকা সংগ্রহে জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, তাদের সবার নাম লেখা আছে জাদুঘরে স্থাপিত বিশেষ ধরনের কাচে। এর মধ্যে সাড়ে তিন টাকা আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীর দেওয়া। বেশ অনেক বছর আগে সে তার কয়েকদিনের টিফিন খরচ বাঁচিয়ে ২৫ ও ৫০ পয়সার কয়েকটি কয়েন জমিয়ে ওই সাড়ে তিন টাকা দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। দেশের প্রতি গভীর মমতায় এই ভালোবাসার কোনো তুলনা না থাকলেও তার নামটি ইতিহাস হয়ে থাকবে। কিন্তু এমন অনেক শিশু রয়েছে, যারা প্রায়ই অসীম সব সাহসী আর অসম্ভব সুন্দর মানবিক কাজ করে যাচ্ছে দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসায়, তাদের কোনো খোঁজই রাখি না আমরা। ইতিহাসের কোনো জীর্ণ পাতায়ও লিপিবদ্ধ থাকে না তাদের নাম।
উজান থেকে মেঘালয়ের তেড়ে আসা ঢল আর দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের কারণে মানবিক বিপর্যয় বিস্তীর্ণ হাওর এলাকাজুড়ে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাড়া করে ফেলছে সেখানকার ফসলহারা দুর্গত মানুষদের। তাদের একাংশের জন্য অন্তত এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দিতে আমরা গণমাধ্যমের কয়েকজন কর্মী মিলে উদ্যোগ নিই ত্রাণ কার্যক্রমের। সেই কার্যক্রমে কেউ কেউ সাড়া দিয়েছেন। সংখ্যার বিচারে কতজন আমাদের সঙ্গে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সে বিতর্কে এখন না-ই বা গেলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই আমরা পেয়ে গেলাম ৩ কোটি চল্লিশ লাখ টাকার সাহায্য। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? আচ্ছা, টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে আর মা-বাবার কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া টাকায় ১৫ জন শিশুর নিষ্পাপ বুকের ভালোবাসায় যদি তিনশ চল্লিশ টাকার তহবিল গঠন করা হয় দুর্গত মানুষের জন্য, সেটাকে আপনি ঠিক কত টাকার সমপরিমাণ বলবেন? আমরা জানি না! খবরটা সিরাজগঞ্জ থেকে সহকর্মী সাংবাদিক স্বপন মির্জা যখন জানালেন, তখন বারবার ভিজে উঠতে চাইছিল চোখ জোড়া।
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের খুকনী গ্রামের হতদরিদ্র তাঁত শ্রমিক আর নাপিতের সন্তান ওরা। হাওরের সবহারা মানুষের পাশে দাঁড়াতে আমাদের কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর উদ্যোগের কথা ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরে তা ওদেরকে শোনান সমাজকর্মী মোশাররফ হোসেন খান। ব্যস, তারপর বাকিটা ওদের কাজ। ফসলহারা মানুষের চোখের পানি নাড়া দেয় ওদের নরম তুলতুলে হৃদয়ে। দুই দিন ধরে ওই টাকা জমিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে ওই ক্ষুদে বীরেরা। আমরা তা গ্রহণ করি অবনত মস্তকে, চোখের জলে…! অনেক বিত্তবান আর ক্ষমতাশালীরা যখন মানুষের কষ্টে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন তখন ওই শিশুরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমাজের নির্লজ্জ অক্ষমতাকে।
বেশ আগে রেল লাইনে বড় একটি ত্রুটি হঠাৎ চোখে পড়ার পর এক শিশু নিজের গায়ের লাল শার্ট উড়িয়ে সংকেত দিয়ে ঠিক সেই সময়ে আসতে থাকা একটি চলন্ত ট্রেনকে থামিয়ে দিয়েছিল। ১০/১১ বছরের এক শিশুর গভীর ভাবনার উপস্থিত বুদ্ধিতে সম্ভাব্য এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছিল সহস্রাধিক মানুষের প্রাণ। দেশের সব পত্রিকায় বড় বড় করে করে সেই সংবাদ ছাপা হয়েছিল। গেল বছর ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার পশ্চিম কোনপাড়া গ্রামের কয়েকজন শিশু ও কিশোর মিলে তাদের স্কুলের টিফিনের টাকা জমিয়ে একটা অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করে। আশপাশে কোনো শহীদ মিনার না থাকায় শহীদ দিবসে ফুল দিতে না পারায় তাদের বেশ মনোকষ্ট আর অভিমান ছিল। তারপর তাদের এই উদ্যোগ। এর আগে মুন্সিগঞ্জেও একদল স্কুলগামী শিশু তাদের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ককশিট আর কালো কাপড় কিনে তৈরি করে ভালোবাসার শহীদ মিনার। তারপর প্রভাতফেরি শেষে তাতে ফুল দিয়ে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে শিশুরা। ঠাকুরগাঁওয়ে একবার এভাবে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে দুস্থ অসহায় মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছিল স্কুলপড়–য়া শিশুরা। গত বছর নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে মা এবং যার সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্ছিল তার বিরুদ্ধে মামলা করে ফেলে ঝালকাঠির মেয়ে শারমিন। এ রকম আরও অনেক ঘটনা আছে। কিন্তু কারোর কোনো স্বীকৃতি নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ (আইডবিউসি) ২০১৭’ পুরস্কার অর্জন করেছে শারমিন। আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলেও জাতীয় কোনো পুরস্কার পায়নি শারমিনের সাহসিকতা। খুব নীরবে এই শিশু-কিশোররা যে দেশ গড়ার অসীম সাহসী কাজ করে ফেলছে নিজেদের উদ্যোগে, উৎসাহের অভাবে তাদের মধ্যকার অমিত যে সম্ভাবনাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি কখনো?
সমাজসেবা, শিল্পকলা, সাংবাদিকতা, গবেষণা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া হয় একুশে পদকÑ স্বাধীনতা পদক। বড়রা তাদের কাজে স্বীকৃতি পেলে ছোটরা কেন বঞ্চিত হবে তাদের সৃজনশীল আর মহৎ কাজের অনুপ্রেরণা থেকে? আমার মনে হয়, শিশু-কিশোররা মাঝে মধ্যে যে অসম্ভব সুন্দর কাজগুলো করে ফেলছে বড়দের সামনে ছ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে, তাদের জন্যও বছরে একটি বিশেষ ক্যাটাগরিতে রাষ্ট্রীয় পদক প্রবর্তনের ব্যবস্থা করা উচিত। অথবা জাতীয় শিশু দিবস নামে যে একটি বিশেষ দিবস আছে আমাদের, সেই দিনটিতেও তাদেরকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা যেতে পারে। এতে সমাজসেবামূলক কাজে তাদের আগ্রহ আরও বাড়বে, দেশের প্রতি ভালোবাসার বিবেকটাও ধারালো হবে আরও বেশি।
বুভুক্ষ মানুষগুলোর কষ্ট উপলব্ধি করে নিজেদের টিফিনের টাকা দান করা মোরসালিন, সাগর শীল, রিজন, আশিক, রিফাত, রাব্বির মতো মানবতার পথ প্রদর্শক শিশু-কিশোররা এগিয়ে যাক এদেশের ভাগ্য নিয়ন্তা হয়ে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সড়হলঁৎঢ়ধহহধ৭৭৭@মসধরষ.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান