উত্তরাঞ্চলের সর্বপ্রথম ও প্রাচীনতম সৈয়দপুরের গির্জা
উত্তরের ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল ব্রিটিশ কোম্পানির শাসনামলে। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে স্থাপিত হলে সৈয়দপুরের গুরুত্ব বেড়ে যায় বহুগুণ। সে সময়ে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সৈয়দপুর ছিল একটি ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশন। এই স্টেশনের ঠিক উত্তর পার্শ্বে স্থাপন করা হয় ছোট একটি লোকোশেড। এই লোকোশেডটি ছিল আজকের দেশের বৃহত্তম সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ভিত্তিভূমি। পরবর্তীতে লোকোশেডটিকে ঘিরেই ১১০ একর জমি নিয়ে গড়ে তোলা হয় বিশাল রেলওয়ে কারখানাটি। এ কারখানাটি স্থাপনে ব্রিটিশরা বিবেচনায় নিয়েছিল এর অবস্থান, জলবায়ূ ও পরিবেশগত অবস্থান। এ কারখানায় বাঙালি ও বিহারীর সাথে কাজ করতো বহু ব্রিটিশসহ এ্যাংলো ইন্ডিয়ান ক্যাথলিক প্রোটেষ্টান্ট খ্রিস্টান। এদের বসবাসের জন্য গড়ে তোলা হয় বেশ কয়েকটি আবাসিক এলাকা। এর মধ্যে সাব-অর্ডিনেট কলোনি, সাহেবপাড়া ও অফিসার্স ক্লাব অন্যতম।
১৮৮৬ সালে তাদের ধর্মীয় উপাসনার জন্য ব্রিটিশ সরকার সাহেবপাড়ার দুই প্রান্তে দুটি গির্জা নির্মাণ করে। এর একটি ছিল রোমান ক্যাথলিক ও অপরটি প্রোটেষ্টান্ট স¤প্রদায়ের। এ গির্জা দুটি উত্তরাঞ্চলের সর্বপ্রথম ও প্রাচীনতম গির্জা। এর নির্মাণ শৈলী রোমান ও ইউরোপীয় স্থাপত্য কলায় সমৃদ্ধ। এর মধ্যে রেলওয়ে কারখানা গেট সংলগ্ন গির্জাটি কুমারী মরিযমের নামে উৎসর্গ করা হয়। ব্রিটিশ সরকার ১৮৯২ সালে গির্জার পাশেই রেলওয়ের ৩ বিঘা জমির উপর পুরোহিত ভবন নির্মাণ করে। তখন ফাদার ফ্রান্সিস বোক্কা লিমে মহমতি যীশু খ্রিস্টের ভক্ত-অনুসারীদের নিয়ে আধ্যাত্মিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ইংরেজ ও এ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা নিজ নিজ দেশে ফিরে গেলেও কিছু সংখ্যব এ্যাংলো ইন্ডিয়ান থেকে যায়। এছাড়াও অন্যান্য খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোক বলতে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, বরিশাল, পাবনা, কুষ্টিয়াসহ প্রভৃতি জেলার অধিবাসী চাকরী করতে এসে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এখানে খ্রিস্টযাগ সংঘবদ্ধভাবে বাইবেল পাঠ, উপদেশ, প্রার্থণা পরিচালনা করতেন এ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন আগে অনেকে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও অষ্ট্রেলিয়া চলে যান।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৬ এপ্রিল সৈয়দপুরে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু হলে অবাঙালি ও পাকসেনাদের হাতে শহীদ হন বেশ কয়েকজন খ্রিস্টান। যুদ্ধের সেই ভয়াবহ সংকটকালেও ক্যাথলিক ও প্রোটেষ্টান্ট সম্প্রদায়ের বহু খ্রিস্টভক্ত গির্জা ও সিস্টারদের কনভেষ্টে অবরুদ্ধ জীবন- যাপন করে। ব্রিটিশ ও এ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা চলে যাবার পর সৈয়দপুরে বাঙালি খ্রিস্টভক্ত ও খ্রিস্টানদের বিভিন্ন বিপদে যারা এগিয়ে আসেন তারা হলেন ফাদার কালিন্তস কোড়াইয়া, ফাদার পরিবলদি, ফাদার রায়ারবয়েন ও ফাদার প্যাট্রেক গমেজ অন্যতম।
সৈয়দপুরের পুরনো গির্জা ও পুরোহিত ভবন নির্মাণের পর সিস্টারস অব চ্যারিটি সম্প্রদায়ের সিস্টাররা এই ধর্মপল্লীতে আসেন। পরে এদের প্রচেষ্টায় সেন্ট জেরোজা নামে একটি স্কুল চালু করা হয়। সেখানে এখনও সুনামের সাথে ছেলে-মেয়রা লেখাপড়া করছেন। একসময় রেলওয়ে কারখানাকে কেন্দ্র করে সৈয়দপুরে আগমন ঘটেছিল ব্রিটিশ ও এ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের। কালের বিবর্তনে তারা চলে গেলেও রয়ে গেছে ক্ষুদ্র পরিসরে তাদের গড়া ধর্মপল্লী সাব-অর্ডিনেট কলোনি, সাহেবপাড়া ও অফিসার্স ক্লাব। সে সাহেবরা আর নেই। কিন্তু রয়েছে সাহেবপাড়ার দুই প্রান্তে তাদের গড়া দুটি দর্শনীয় গির্জা। যার স্থাপত্য কলা ও নির্মাণ শৈলী মুগ্ধ করে আগত প্রতিটি মানুষকে।