গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হলো শহীদ ফাদার লুকাশ মারান্ডীকে
বিডি খ্রিস্টান নিউজ
২১ এপ্রিল ঠাকুরগায়ের রুহিয়া ক্যাথলিক গির্জায় গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়েছে শহীদ ফাদার লুকাশ মারান্ডীকে। ১৯৭১ সালের এই দিনে তিনি শহীদ হয়েছিলেন। রুহিয়া ক্যাথলিক গির্জায় ১জন বিশপ, ৭জন পুরোহিত সহ তিনশত খ্রিস্টভক্ত তার আত্মার কল্যাণে প্রার্থনা করেন। বিশেষ খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন দিনাজপুরের বিশপ সেবাষ্টিয়ান টুডু। স্মৃতিচারণে বক্তারা বলেন, ফাদার লুকাশ মারান্ডী ছিলেন একজন দেশ প্রেমিক মানুষ। মৃত্যু ভয় থাকা সত্ত্বেও তিনি দেশের মানুষের টানে যুদ্ধের সময় দেশে থেকে যান। রুহিয়ার জাতি-ধর্ম-বর্ণ সকল মানুষের হৃদয়ে বাস করছেন শহীদ ফাদার লুকাশ মারান্ডী।
বিশপ সেবাস্টিয়ান টুডু শহীদ ফাদার লুকাশ মারান্ডীর সমাধী স্তম্ভে ফুলের মালা দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনি:
মৃত্যু চিরন্তন। তার করাল গ্রাসে সবাইকে আত্মহুতি দিতে হয়। তাই বুঝি যখন তখন তার আগমন। আর এমনি করে আকস্মাৎ একদিন যে উপস্থিত হলো ফাদার লুকাশের কাছে।
১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল শুক্রবার দিন পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে এই আদর্শ পুরোহিত মৃত্যুবরণ করেন। পাকসেনারা তার ঘরে প্রবেশ করে গুলি করে তাকে হত্যা করে। তিনি একা মিশনে অবস্থান করছিলেন এবং আশেপাশের গ্রামের প্রায় সবাই পাকসেনাদের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য ভারতে চলে গিয়েছিলেন। দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের একমাত্র দেশীয় পুরোহিতের জীবন-মধ্যাহ্নে হঠাৎ করে রবি অস্ত গেল। একটানা আঠার বছর আক্লান্ত পরিশ্রমের পর তার এই আকস্মিক মৃত্যুতে সবাই মর্মাহত। এই আদর্শবান সাঁওতাল পুরোহিতের জীবন-কাহিনী সংক্ষেপে আলোচনা করতে গেলে তার বহুমুখী ও কার্যাবলী দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তার মৃদু ব্যবহার, কঠোর কর্ম-প্রবণতা, নিজ কর্তব্যে একাগ্রতা এবং ছোট ছেলেমেয়েদের প্রতি অগাথ ভালবাসাই তার চরিত্রের পরিচয় বহন করে।
১৯২২ সালে, তৎকালিন দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের বেণীদুয়ার ধর্মপল্লীতে একটি আদর্শ মধ্যবিত্ত খ্রিস্টান পরিবারে ফা.লুকাশ জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব ও বাল্যকাল তিনি বেণীদুয়ার মিশনেই অতিবাহিত করেন। পরে তিনি দিনাজপুর সেন্ট ফিলিপস হাইস্কুলে ও দিনাজপুর জিলা স্কুলে যোগদিয়ে তার মাধ্যমিক পড়াশুনা শেষ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি বিহারের রাঁচী সেমিনারীতে গমন করেন এবং তথা হতে নেল্লোর সেমিনারীতে যান। অক্লান্ত পরিশ্রম, বিশ্বস্ততা, বাধ্যতা ও একাগ্রচিত্ত নিয়ে তিনি পৌরহিত্য পদেও অধ্যয়ন উত্ত সেমিনারীতেই শেষ করেন। তারপর ১৯৫৩ সনের ডিসেম্বর মাসে তিনি দিনাজপুরের বিশপ ওবের্ত, পিমে কর্তৃক পৌরোহিত্য পদে অভিষিক্ত হন।
ফাদার লুকাশ তার কর্মজীবনের প্রথম কয়টি বছর মারীয়ামপুর ধর্মপল্লীর সহকারী পুরোহিতরূপে কাটান। পরে তিনি দিনাজপুর সেন্ট ফিলিপস হাইস্কুলের ছাত্রবাসের পরিচালক হয়ে দিনাজপুর ফিরে আসেন। এখানে থাকাকালে তিনি কিছুদিন সেন্ট যোসেফ সেমিনারীর আধ্যাত্মিক পরিচালকরূপে কাটান। পরে তিনি দিনাজপুর সেন্ট ফিলিপস হাইস্কুলের ছাত্রাবাসের পরিচালক হয়ে দিনাজপুর ফিরে আসেন। এখানে থাকাকালে তিনি কিছুদিন সেন্ট যোসেফ’স সেমিনারীর আধ্যাত্মিক পরিচালক রূপেও কাজ করেন। অপঃপর তিনি রুহিয়া গমন করেন। এই এখানেই তিনি তার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো অতিবাহিত করেন।
জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই ফাদার লুকাশ বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করে গেছেন। তার মৃদু ব্যবহার, অক্লান্ত পরিশ্রম, বিশ্বাস এবং সঙ্গীতপ্রিয়তা তার চরিত্রের বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য। ফাদার লুকাশ ছিলেন একজন সমাজদরদী। তিনি বিশেষ করে সাঁওতাল সমাজের উন্নতির জন্য অৎস্র পরিশ্রম করেছেন। তাদের বহুমুখী উন্নতির জন্য তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন ঋণদান সমিতি, সমবায় সমিতি এবং কৃষি সমিতি। এগুলোই হলো তার সমাজ দরদের স্বর্ণাক্ষর। এই ব্যক্তি অতি অল্প বয়সে ঈশ্বরের চিরন্তন ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। মৃত্যুর পর তার বিধ্বস্ত দেহটিকে গরুর গাড়ীতে পশ্চিমবঙ্গের ইসলামপুরে সমাধিস্ত করা হয়। (জীবনি সূত্র: প্রতিবেশী, ৩য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ সাল।)