ইন্দোনেশিয়ায় ফতোয়া ‘১৮ বছরের নিচে বিয়ে নয়’ বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বাংলাদেশ কেন পেছনের পথে হাঁটছে
উম্মুল ওয়ারা সুইটি : ‘১৮ বছরের নিচে বিয়ে নয়’ বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ইন্দোনেশিয়ার নারী আলেমদের দেওয়া ফতোয়াকে সময়োপযোগী বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার নেতারা। তারা বলেছেন, বাল্যবিয়ে নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার এই সিদ্ধান্ত দেশটিকে অনেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু সম্প্রতি আমাদের দেশে বাল্যবিয়ে নিয়ে সরকারের আইনে বিশেষ সুযোগে ১৮ বছরের নিচে বিয়ের যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা পেছনে যাওয়ার সামিল। তারা আইনটির এই বিশেষ সুযোগের এই বিধান পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ইন্দোনেশিয়ায় নতুন এবং আধুনিক আইন করছে। আর আমরা বিশেষ সুযোগের বিধান রেখে পুরনো আইনে ফিরে যাচ্ছি। তিনি বলেন, এমনিতেই জন্ম নিবন্ধন পদ্ধতি শক্তিশালী হয়নি। ফলে, বিয়ের জন্য অনেকেই ১৩/১৪ বছরের মেয়েদের সার্টিফিকেট বয়স ১৯/২০ করে বিয়ে দিচ্ছে। আর আইনের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অভিভাবকরাও। আবার এমনও ঘটনা ঘটছেÑ ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে পারবে না এবং ভালো সম্বন্ধ এসেছে এই দোহাই দিয়ে শিশু বিয়ে দিচ্ছে। যদিও আইনে বলা হয়েছে, শিশু বা কিশোরীর নাজুক পরিস্থিতি হলেই কেবল পরিবার এবং সমাজের লোকজন মিলে ১৮ বছরের নিচে বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারবে। বাস্তবে তা নিয়ন্ত্রণ করবে কীভাবে? কারণ এখনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ জানে না কিশোরী বিয়ে দিলে তার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি খারাপ হয় এবং অল্প বয়সে মা হলে মাতৃস্বাস্থ্য এবং শিশুর স্বাস্থ্য দুটোই হুমকিতে পড়ে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, আইনে যে সুযোগ রয়েছে সেটা বাস্তবে হবে না। এখানে ইন্দোনেশিয়া আর বাংলাদেশে দুটো বিপরীত ঘটনা ঘটেছে। তাদের দেশে প্রতি ৪ জনে একজন মেয়ের শিশু বয়সে বিয়ে হয়। আর সেখানে নারী আলেমরা যে ফতোয়া দিয়েছেন তা হলো একটি দেশের সত্যিকারের এগিয়ে যাওয়ার ধাপ। আমি তাদের স্বাগত জানাই। আমরা তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করি। কারণ বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে বিয়ের বয়স ১৮ বছর। তবে এর মধ্যে বিশেষ সুযোগের যে বিধানটি রাখা হয়েছে তা আত্মঘাতী। আমাদের বর্তমান সরকার নারীবান্ধব সরকার। নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান অনেক বেশি। তাই আমরা আশা করি বিশেষ সুযোগের এই বিধানটি সংসদে সংশোধন করা হবে।
মানবাধিকার নেত্রী খুশি কবীর বলেন, ইন্দোনেশিয়ার ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নেবো? না কি তারা আমাদের কাছ থেকে আগেই শিক্ষা নিয়ে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর করার ফতোয়া দিয়েছে? তিনি বলেন, গত অধিবেশনে আমাদের বিরোধিতার পরও সংসদে বিশেষ কারণ বলে বিয়ের বিষয়ে ১৪ বছরের বিধান রাখা হয়েছে। আর তাতে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের পরিবর্তে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমাদের দাবি-একজন নারীবান্ধব সরকার প্রধান তিনি। তিনিই যেনো এই আইনে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ের বিষয়ে যে সুযোগটি রাখা হয়েছে তা যেন তুলে দেন।
তবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একাংশের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার এমপি বলেন, ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে নিয়ে বিশেষ সুযোগের বিষয়ে অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। কারণ সরকার এই আইন করার পাশাপাশি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে অনেক ভালো ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। কিশোরী ক্লাব করা হচ্ছে। তারা নিজেরাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে মাঠে নেমেছে। তিনি বলেন, বাস্তবতার নীরিখে এই সুযোগ রাখা হয়েছে। এমনকি মেয়ের বাবা-মা বললেও এই ধরনের বিয়ে হবে না। সত্যিকার অর্থে যদি মেয়েটি নাজুক কোনো পরিস্থিতিতে না পড়ে। তিনি বলেন, এই বিষয়টিও বেশি বেশি করে প্রচার করতে হবে। ইন্দোনেশিয়ার এই ফতোয়াকে নজিরবিহীন উল্লেখ করে শিরিন আখতার বলেন, সব দেশ থেকেই বাল্যবিয়ে বন্ধের প্রতিবাদ আসবে। তাদের সরকার এই ফতোয়া আমলে নিয়ে মেয়ের বিয়ের বয়স ১৮ করলে আরেকটি ইতিহাস হবে। তিনি নারী নেত্রীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, কেউ যেনো এই সুযোগের অপব্যবহার না করে সে ব্যাপারে সবাইকে সোচ্চার থাকতে হবে।
উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়ার নারী আলেমরা বাল্যবিবাহের উপর নজিরবিহীন এক ফতোয়া জারি করেছেন। তারা সরকারের কাছে মেয়েদের বিয়ের বয়স আইনগত ভাবে ১৮ ধার্য করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই ফতোয়া আইনের বিচারে বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু প্রভাবশালী। জাভা দ্বীপের সিরেবনে অনুষ্ঠিত এই কংগ্রেসটি ছিল নারী আলেমদের সর্বপ্রথম সবচেয়ে বড় সম্মেলন।