টিভি সিরিয়াল নয়, সিরিয়াল কিলার!
অরুণ কুমার বিশ^াস
সিরিয়াল কিলারের কথা আমরা সবাই কম বেশি জানি। এরা এক ধরনের সাইকোপ্যাথ, যারা কিনা কোনো কারণ ছাড়াই নিজেদের অসুস্থ মনোবাঞ্ছা চরিতার্থ করার জন্য একের পর এক মানুষ খুন করে। ধরাও খায়, জেল খেটে বেরিয়ে এসে আবারও নরহত্যা করে। যেন খুনেই ওদের আনন্দ। বস্তুত এরা একরকম মনোবৈকল্যের শিকার।
এ তো গেল শারীরিক খুনের কথা। কিন্তু যারা বিপুলসংখ্যক দর্শককে কোনো একটি বিষয়ে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ও মোহগ্রস্ত করে ফেলে তাদের কী বলবেন! আরেকটু খোলসা করে বলি, সাম্প্রতিক কিছু টেলিভিশন সিরিয়াল বা ধারাবাহিক নাটক আমাদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এসব সিরিয়াল দেখে কেমন এক মোহের ঘোরে বাস করছি আমরা। গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম ফেলে কিসের নেশায় যেন অহর্নিশ গোগ্রাসে এসব সিরিয়াল গিলছি আমরা। বলা বাহুল্য, পুরুষরা এক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার। অর্থাৎ সিরিয়াল যারা দেখছে তাদের মধ্যে নারীর আধিক্য লক্ষণীয়। সূক্ষ্ম বিচারে এই শ্রেণির নারীরা স্বভাবতই কর্মবিমুখ, তাদের খেয়েবসে আদৌ কোনো কাজ নেই। উহারা উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের ঘরণী। কর্মজীবী নারীর সিরিয়াল দেখার সময় নেই, তারা এসবের ক্ষতিকর প্রভাবমুক্ত।
প্রশ্ন হলো, কী ধরনের ধারাবাহিক দেখছে তারা! এক একটা নাটক (আদৌ নাটক কি!) পাঁচশ থেকে হাজার পর্বের হয়ে থাকে। টিআরপি অনুযায়ী পাবলিক খেলে পর্বের সংখ্যা আরও বাড়ে। ভারতীয় চ্যানেলগুলোর এক্ষেত্রে জয় জয়কার। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সিরিয়ালের পাশাপাশি মুম্বাইকেন্দ্রিক হিন্দি সিরিয়ালও কিছু কম যায় না। যারা এসব দেখেন, তারা বুয়ার হাতে সংসার তুলে দিয়ে পারলে খাবার-দাবার সঙ্গে করে নিয়ে গুছিয়ে বসেন টিভি সেটের সামনে। যেন জীবনের মোক্ষ একটাইÑ জমিয়ে বসে সিরিয়াল নাটক গেলা।
কী দেখেন এসব নাটকে, প্রশ্নটা আমাকে প্রায়শ খুব জ্বালাতন করে। কী মধু আছে সেখানে! বুড়োবুড়ি দেখে সে এক কথা। কিন্তু যারা মধ্যবয়সী, সংসারে করণীয় কিছু আছে, তারা কেন জোঁকের মতো সেঁটে থাকে এসব সিরিয়ালে! এমনই আর্কষণ যে নুন দিলেও জোঁকের ঝোঁক থামে না।
রাজ্যের কুটনামি আর আজেবাজে ঘরোয়া ঝামেলায় ঠাসা এসব সিরিয়াল। তার মধ্যে বউ-শাশুড়ির কূটকচাল অবশ্যই থাকবে। সঙ্গে যুক্ত থাকে ননদ-ভাবির কাঁদুনি। এমন এমন সব উদ্ভট সমস্যা পাকানো হয় যে, কোনো শুভবুদ্ধির মানুষ দুদ- এ জিনিস দেখতে পারে না। অথচ সমঝদার (!) নারী দর্শকগণ সিরিয়াল চলাকালীন সময় এমন কোনো বিষয় কানে নিতে অপারগ, যাতে কিনা টিভি সেটের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। কাঁঠালের আঠা বললে কম বলা হয়, বলা যায় সিরিয়ালের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক শাশ্বত, অবিচল ও চির অটুট।
দেশীয় চ্যানেল থাকতে এসব কেন দেখেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে একজন ব্যাপক ক্ষোভ ও অনুযোগের সুরে নাসিকা কুঞ্চিত করে বলেন, আমাদের নাটক আর মানসম্মত নেই। নেহাতই সাদামাটা ও গল্পবিহীন। এসব দেখে মনে কোনো ভাবের উদয় হয় না।
বেড়ে বলেছেন বটে। অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, সংশপ্তকÑ সেসব নাটক কি আর হয় এখন! প্রচুর চ্যানেল চানাচুরের মতো কুড়কুড়ে অনুষ্ঠান উপহার দিচ্ছে। টিভিসি কম, তাই খরচ সংকুলান হয় না। বেশির ভাগ নাটক রম্য ধাঁচের বা বলা যায় স্থ’ূল কমেডি। মেধা দিয়ে হাসানোর প্রয়াস নেই এসব নাটকে, শুধুই ভাঁড়ামো। বেশির ভাগ নাটকের রকমসকম এক- কয়েকটি মুখ ঘুরেফিরে আসে, এক রকম সংলাপ আওড়ায়। নাহ, এ দিয়ে ভারতমুখিনতা ছাড়ানো যাবে না। নিন্দুকেরা বলেন, আমাদের নাটকে এখন ‘বাফুনারি’ চলে। নাটক লেখা থেকে অভিনয়-সবখানে নৈরাজ্য বিরাজ করছে, তাই মানসম্মত নাটক হচ্ছে না। নাটক সংখ্যায় বেড়েছে, কিন্তু মান থাকছে না। এত এত চ্যানেলকে নিত্য সাপ্লাই দিতে গিয়ে নাটকের লোকদের এখন প্রাণ ওষ্ঠাগত, স্রেফ নাভিশ্বাস উঠে গেছে। কিছুটা হলেও সত্যি কথা। নইলে দেশি দর্শক বিদেশপানে মুখ ফেরাবে কেন! চিত্তাকর্ষক ইনডোর গেমস-এর এন্তেজাম না করেই যদি বলেন, খবরদার! ঘরের বাইরে যাবে না। এ-কথা কেউ শুনবে, না মানবে! তাই আমাদের বিপথগামী দর্শককূল ফিরিয়ে আনতে হলে ভাঁড়ামো বাদ দিয়ে মনোগ্রাহী উচ্চলয়ের নাটক সৃষ্টি করতে হবে।
আমাদের মা-বোনদেরও বলি, বলিহারি যাই তোমাদের সিরিয়াল-প্রীতি দেখে। ওসব কূটকচালি না দেখে বুঝি আর চলছে না! ওই সময়টুকু ভাল কোনো বই পড়ে বা নিদেনপক্ষে সংসারে মনোনিবেশ করলে বেশ হয়। তাও যদি ভাল না লাগে তো একটু হেঁটে আসুন না খোলা হাওয়ায়। শরীর ঝরঝরে হবে, মনও ভাল থাকবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রথম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
সম্পাদনা: আশিক রহমান