‘তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে’
কাকন রেজা
বাংলাদেশে এখন এক ধরনের বিহ্বলতার সময় চলছে। এতে অনেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। বলা যায় বৈপরীত্যের টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সময়, যা অনেকের ভাষায় ‘পরিচিতির ক্রান্তিকাল’। আমি নিজে বৈপরীত্য নিয়ে কাজ করি, বৈপরীত্য খুঁজে বেড়াই। কারণ বৈপরীত্যের মাঝ থেকেই খুঁজে নেওয়া সম্ভব সঠিক জিনিসটি। আর সেই সঠিক জিনিস খুঁজতেই আমি বারবার আমাদের এই ভূ-খ-ের সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যের কথা তুলে ধরেছি। বলেছি আমাদের সবকিছুর মূলে রয়েছে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব। নিজস্ব সংস্কৃতিকে না চেনা বা না চেনার আত্মঘাতী প্রচেষ্টার কারণেই আজ একটি দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অনেকটা রাখাল বালকের ‘বাঘ এলো’র গল্পের মতোন। এখন সত্যিই বাঘ এসে পড়েছে।
সেই দ্বান্দ্বিক কারণেই সংস্কৃতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে আজ নানা বিষয়ে কথা উঠছে। কথা উঠছে ‘গডেস অব জাস্টিজ’ এর জাস্টিফিকেশন নিয়ে, কথা উঠছে দেশি গণমাধ্যমে অপরিচিত এক সাহিত্যিকের ‘ড্রামাটিক’ উত্থান নিয়ে। কথা উঠছে রাজনীতির চিরচেনা আবহ হঠাৎ পরিবর্তনের ঝড়ো আভাস দেখে। এমনটি যে হবে তা অনেক আগেই অনুধাবন করেছিলেন খ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ মরহুম আবুল মনসুর আহমদ। তিনি তার জীবদ্দশাতেই জানিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের ‘কালচারে’র সঠিক ‘ক্যারেক্টার’ সম্পর্কে। তিনি বলতে চেষ্টা করেছিলেন ‘কালচারে’র ‘ক্যারেক্টার’ ‘লস্ট’ হলে সবকিছুই ‘লস্ট’ হবে।
আবুল মনুসর আহমদ তার ‘পাক-বাংলার কালচার’ পরবর্তীতে যার নাম পাল্টে রেখেছিলেন ‘বাংলাদেশের কালচার’ গ্রন্থটিতে মোটামুটি বিষদ এবং সহজ বর্ণনায় ‘কালচার’ তথা সংস্কৃতির মূল চরিত্রটি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার সেই প্রয়াস সফল হয়নি আমাদের একশ্রেণির সংস্কৃতি বিশারদের কারণে। তারা গ্রিক সংস্কৃতি, রোমান সংস্কৃতি, আর্য সংস্কৃতি বুঝেছেন দাবি করলেও নিজ দেশের সাংস্কৃতিক চরিত্রটি আজও বুঝে উঠতে পারেননি। অথচ এই শ্রেণিটিই দেশীয় সংস্কৃতির সর্বাধিক ‘বুঝদার’ হিসেবে দাবি করেন। আবুল মনসুর আহমদ বলে গিয়েছিলেন, ‘সংস্কৃতির আশি ভাগ আসে ধর্ম থেকে’। মানুষের যাপিত জীবনের অনেকটা জুড়েই থাকে ধর্ম আর তা বুঝেই তিনি বলেছিলেন এ কথা। সংস্কৃতি মানুষের যাপিত জীবনের নির্যাস এবং মানুষের যাপিত জীবনকে নিয়েই সংস্কৃতি। এর আগেও অনেকবার এ কথা বলেছি। আর সে কারণেই সংস্কৃতির চরিত্র একেক ভূ-খ-ে একেক রকম। আমাদের ভূ-খ-ের যে সংস্কৃতি, তার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী বা প্রতিবেশী কোনো দেশের সংস্কৃতি মিলবে না। কারণ তাদের যাপিত জীবনের ধরন আর আমাদের যাপিত জীবন এক নয়। কলকাতার সিনেমা, নাটকে পূজাপাঠ, সংস্কৃত শ্লোক থাকবে এতে দোষের কিছু নেই, এটাই তাদের যাপিত জীবন, সংস্কৃতি। বর্মা অধুনা মিয়ানমারের ছবি, সিনেমায় গৌতম বুদ্ধ থাকবেন, বৌদ্ধ মঠ থাকবে এটাই স্বাভাবিক এটাই তাদের জীবন চিত্র। একইভাবে হলিউডে বিয়ের দৃশ্য চিত্রায়িত হবে চার্চে, সঙ্গে উঠে আসবে ওয়াইন গ্লাসে চিয়ার্স বলে টোস্ট। এটাই তাদের যাপিত জীবন, এটাই তাদের সংস্কৃতি এবং এটাই সত্য ও স্বাভাবিক। এর বাইরে কিছু নেই।
কিন্তু আমাদের দেশে একটি শ্রেণির কাছে সংস্কৃতি মানে এক বায়বীয় জীবনের চিত্র। ‘সংস্কৃতি’ তাদের কাছে ‘ফ্যান্টাসি কিংডম’। তারা সংস্কৃত শ্লোক, মঠের সঙ্গে ওয়াইন গ্লাসের চিয়ার্স মিলে বানাতে চান সাংস্কৃতিক ফ্যান্টাসি এবং তাকেই আমাদের সংস্কৃতি বলে গিলিয়ে দিতে চান। তা কী সম্ভব? রিয়েলিটির সঙ্গে কী ম্যাজিক রিয়েলিটি যায়? কল্পনা আর বাস্তব কী এক জিনিস? একটি আর্ট ফিল্মে (!) দেখলাম, একজন নারী মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, তাকে ঘিরে বর্ণিত হচ্ছে গল্প, তৈরি হচ্ছে একটি ‘ম্যাজিক কালচার’। আমাদের সমাজে কতজন নারী মদ্যপান করেন, আমাদের সামাজিক জীবনের কতটা জুড়ে নারীর মদ্যপান, সিগারেট ফোঁকা? এটা শতকরার কোনো ভাগেই পড়ে না। অথচ কিছু লোকের কাছে সেই বিস্ময়কর চিত্রটিই সংস্কৃতি। তারা এটাকে স্বাধীনতা হিসেবে আখ্যায়িত করতে চান! তারা নারীর মদ্যপানকে, সিগারেট টানাকে মুক্তির চিত্র হিসেবে দেখেন! কী বলবেন এদের, এরা কী যাপিত জীবনের পালস বোঝেন? তারা যা বোঝেন তা হলো হয় ‘যাদু বাস্তবতা’ না হয় ‘সুরিয়ালিজম’ পরাবাস্তবতা। প্রকৃত বাস্তবতা এদের কখনো বোঝা হয়ে উঠে না, সংস্কৃতি তো পরের চ্যাপ্টার।
এদের সাংস্কৃতিক ধারণা কতটা ঠুনকো তা দু-একটি বিষয়েই পরিষ্কার হয়ে উঠে। দেখবেন, এরা সবসময় আতংকে থাকে, কিছু একটা হলেই, গেল, গেল। জাত-মান-কুল সবই গেল! তাদের এই ভয় মূলত ‘অবস্থান’ হারানো নিয়ে। কল্পিত ‘ম্যাজিক কালচারে’র যে অবস্থান তারা তৈরি করেছেন নিজেদের রুটিরুজির স্বার্থে, তা হারানোর ভয়েই তারা এত ভীত থাকেন। আরে, যে সংস্কৃতি মানুষের যাপিত জীবনকে ঘিরে গড়ে ওঠা তা কী এতই ঠুনকো যে নকিবের গানের মতোন এক আঘাতেই ভেঙে যাবে। মানুষের যাপিত জীবনের চিত্র কী ক্ষণে ক্ষণে রিভার্স হয়, যদি না হয় তাহলে সংস্কৃতি পাল্টাবে কেন?
তারা ভীত থাকেন। কারণ তারা জানেন তাদের কথিত সেই ‘কালচার’ টিকে আছে ‘চাপা’ আর ‘চোঙা’র জোরে। তা না হলে একটি বিদেশি গণমাধ্যম একজন ঔপন্যাসিককে নিয়ে কী লিখল বা না লিখল তাতেই তাদের মাথা নষ্ট হয়ে গেল! সব কাজ ফেলে একযোগে লেগে গেল কাসেম বিন আবুবাকার এর পিছে! তাদের সংস্কৃতির চিন্তাটা যদি ঠুনকোই না হতো তাহলে বিদেশি মাধ্যমের এমন আলোচনাকে গায়েই মাখতো না। তাদের ভয়টা ওই জায়গায় আবুবাকারের লেখায় সাহিত্যমান থাকুক আর না থাকুক অন্তত এ দেশের মানুষের যাপিত জীবনের অর্থাৎ সংস্কৃতির কিছুটা চিত্র তো আছে। যার ফলেই একশ্রেণির মানুষ অনুগামিত হয়েছেন। কিন্তু তাদের সেই ‘যাদু সংস্কৃতি’র মধ্যে তো এ ভূ-খ-ের মানুষের যাপিত জীবনের কোনো চিত্রই নেই। ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট’ নাম দিয়ে তারা সংস্কৃতির আদলে যা মানুষকে গেলাতে চাইছেন তা দেশের আমজনতা নিতে অক্ষম। কারণ আমজনতা ঘরে ফিরে তার স্ত্রী, মা, খালাকে মদ্যপান করতে দেখেন না, সিগারেট ফুঁকতেও না। তাই তো আবুবাকার সাহিত্যমানে উত্তীর্ণ না হয়েও মানুষের ভেতর ছড়িয়ে যান। ‘ম্যাজিক কালচারে’র কালচারিস্টরা এগ্রিকালচারিস্টদেরও পেছনে পড়ে থাকেন, সংস্কৃতির এত এত তত্ত্ব আউড়েও পা হড়কান।
সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের এই চাপ সঙ্গতভাবে পড়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনেও। ‘গডেস অব জাস্টিস’ তথা থেমিসের মূর্তি সরানো নিয়ে চলছে টানাপোড়েন, অস্থিরতা। পক্ষপাতিত্ব আর অস্তিত্বের মধ্যে শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব। থেমিসের মূর্তি প্রসঙ্গটি অন্যকিছু না হোক কিছু মানুষের ভেতরের দ্বন্দ্বটিকে দৃশ্যমান করেছে। অন্ধ পক্ষপাত এবং নিজের অবস্থানগত ইগোর দ্বন্দ্ব এদের বিহ্বল করে ফেলেছে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় করেছে। যার ফলে দেখা দিয়েছে নার্ভাস রিয়েকশন। থেমিসের মূর্তি মূল থিম মেনে করা হয়নি, গ্রিক মূর্তিকে শাড়ি পরানো হয়েছে, এটার শৈল্পিক মান ঠিক হয়নি, কী প্রয়োজন ছিল হাইকোর্টে মূর্তি স্থাপনেরÑ এসব প্রশ্নের উত্থান নার্ভাস রিয়েকশন থেকেই। শুধু এই ক্ষেত্রে নয় অন্যক্ষেত্রেও নার্ভাস রিয়েকশন থেকেই বর্তমান রাজনৈতিক ভাঙাগড়া, মেরূকরণ।
মানুষের যাপিত জীবন নিয়ে সংস্কৃতি এবং যাপিত জীবনকে ঘিরেই রাজনীতি, এটাই চিরন্তন সত্য। আর এ সত্যটাকে আগে থেকেই মানলে ‘ধর্ম নিয়ে রাজনীতি’ বা ‘ধর্ম কেন্দ্রিক রাজনীতি’ এসব প্রশ্নের উদ্ভব হতো না, হবার রাস্তা থাকতো না। যাপিত জীবনের মূল অংশকে বাদ দিয়ে আপনি সংস্কৃতি বানাবেন আর ভাববেন আহা বেশ, এই তো জীবন! তখন তো সেই মূল অংশ সংস্কৃতিতে জায়গা না পেয়ে রাজনীতিতে ভর করবেই আর সেই ভর হবে ক্ষোভের বশে, ক্রোধের বশে। আপনি সংস্কৃতিতে তাকে মিটিয়ে দিতে চাইবেন, সে তো বিকল্প পথে রাজনীতিতে এসে আপনাকে মিটিয়ে দিতে চাইবেই। এটাই তো স্বাভাবিক, আর ‘অস্বাভাবিকতার’ এমন ‘স্বাভাবিক’ অবস্থা সৃষ্টির জন্য আপনার নিজ দায় এড়াবেন কী করে?
ফুটনোট: শেষ করার আগে সুকুমার রায়ের ‘ষোল আনাই মিছে’র মাঝির কথা মনে পড়ল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে কলকাতার বাবু’সম কারও কারও ক্যারিক্যাচারে ভুলে থাকতে চাইলেও বেচারীর কথা মনে পড়ে যায়। আর এমন দ্বান্দ্বিক সময়ে ভুলে থাকাটাই বরং কঠিন। সুকুমার রায়ের কবিতার বয়ানেই বলি,
মাঝি শুধায়, ‘সাঁতার জানো? Ñমাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, ‘মশাই, এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে।’
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান