ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িকতা বিপরীতধর্মী
ইকতেদার আহমেদ
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পৃথিবীতে বসবাসরত প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে ধর্মের প্রভাব অপরিসীম। নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী এমন অনেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায় বয়সের ভারে ন্যুব্জ হওয়া পরবর্তী জীবন সায়াহ্নে যখন রক্তের প্রবাহ ক্রম শীতলতর তখন বিশ্বাসীদের মধ্যে নিজের স্থান করে নিতে পারলে অনেকটা স্বস্তিবোধ করেন। ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসীরা সচরাচর ধর্ম বিষয়ে উদার মনোভাবাপন্ন হয়ে থাকেন, অপরদিকে সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসীরা সচরাচর ধর্মান্ধ হয়ে থাকেন। একজন ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষ হলে তিনি অসাম্প্রদায়িক হবেন এটির যেমন নিশ্চয়তা নেই অনুরূপ একজন ব্যক্তি সাম্প্রদায়িক শুধুমাত্র এ কারণে তিনি অপর ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু এমনটি বলারও অবকাশ নেই।
সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এমন সকল রাষ্ট্রে বিগত শতকে ধর্ম চর্চা নিষিদ্ধ থাকলেও বর্তমান শতকে এসে আগেকার মতো তার আর কঠোর প্রয়োগ নেই। আগেকার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন বর্তমানের রাশিয়ায় এখন যেকোনো ধর্মাবলম্বীর ধর্ম পালনে রাষ্ট্র বাঁধা হিসেবে দাঁড়ায় না; তবে সাম্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত চীন ও কিউবায় ক্ষেত্রবিশেষে ধর্ম চর্চায় রাষ্ট্রের পক্ষ হতে নিয়ন্ত্রণারোপ করতে দেখা যায়।
আমাদের সংবিধান প্রণয়নকালে এ দেশটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিল। অতঃপর দেশ সামরিক শাসনের কবলে পড়লে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিটি ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। উপরোক্ত সংশোধনীটি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা অনুমোদিত হয়। উক্ত সংশোধনীটি বহাল থাকাবস্থায় ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে সংবিধানে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে অন্যান্য ধর্ম শান্তিতে পালন করা যাবে এ কথাটি বলা হয়। আদালত কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করা হলে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়নের মধ্য দিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃধর্মনিরপেক্ষতা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। উপরোক্ত সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ে ইসলামের অবস্থান অক্ষুণœ রেখে অন্যান্য ধর্মকে সহঅবস্থানে নিয়ে এসে বলা হয় তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবেন।
আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আপাতঃ সাংঘর্ষিক মনে হলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সঙ্গে শর্তাংশ যুক্ত করে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র কর্তৃক সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করায় কার্যত সে সাংঘর্ষিকতার অবসান করা হয়েছে। ভারতের সংবিধান প্রণয়নকালে এর প্রস্তাবনায় ধর্মের ও উপাসনার স্বাধীনতার কথা উল্লেখ থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি অনুহ্য ছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রস্তাবনার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি সন্নিবেশিত হলেও সংবিধানের কোথাও অথবা অন্যকোনো আইনে ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিষয়ক কোনোকিছু আলোচনা করা হয়নি।
ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্র দিতে চাইলেও ভারতের জনগণের এক বিরাট অংশের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ গভীরভাবে গ্রথিত থাকার কারণে এ দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে প্রায়শই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হওয়ার ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। ভারতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পরেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অবস্থান। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নিকট গরুর মাংস প্রিয় খাবার হলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিকট এটি শুধু বর্জনীয়ই নয় বরং অনেকের অবস্থান কঠোরভাবে এটি নিধনের বিপক্ষে। ভারতে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অধিকাংশই গরু জবাই কেন্দ্রিক। আর এর প্রতিটিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা মুসলিম জনগোষ্ঠী হত্যাসহ চরমভাবে উৎপীড়ন, নিষ্পেষণ ও লাঞ্ছনার শিকার হয়ে আসছেন।
হিন্দু ধর্মের ইতিহাস অধ্যয়নে জানা যায়, প্রাচীন ভারতে গরুর অন্তর্ভুক্ত ষাঁড় দেবতার উদ্দেশে বলির পর এর মাংস ভক্ষণ করা হতো কিন্তু দুগ্ধ প্রদানকারী গরুর অন্তর্ভুক্ত গাভী জবাই নিষিদ্ধ ছিল। হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বেদে গাভীকে দেবতা উল্লেখপূর্বক দেবের মাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে গরুকে খাদ্যের উৎস এবং জীবনের প্রতিরূপ হিসেবে সম্মানের সঙ্গে দেখা হয়। অনেক হিন্দু ধর্ম বহির্ভূত মানুষ মনে করে থাকে হিন্দুরা গরুর উপাসনা করে। আসলে ব্যাপারটি তা নয়। সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় হিন্দু ধর্মে গরু পবিত্র হওয়ার চেয়ে জবাই নিষিদ্ধ। মনে করা হয় জৈন ধর্মের প্রভাব থেকে হিন্দু ধর্মে গরু নিধন বন্ধ করা হয়। প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের মধ্যে যখন গরুর মাংস ভক্ষণ অনুমিত ছিল তখনো বেদে নিরামিষ ভোজীদেরকে উৎসাহিত করা হয়েছিল।
ভারতে যখন উগ্রাবাদী হিন্দু দলসমূহ গরু জবাই সম্পূর্ণ বন্ধের জন্য সোচ্চার এবং তাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কিছু কিছু রাজ্যে যখন গরু জবাইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে তখন দেখা যায়, ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গরুর মাংস রপ্তানিকারক দেশ। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সে বছর ভারত ১৭ লাখ ৬৫ হাজার টন গরুর মাংস রপ্তানি করেছে যা পৃথিবীর সামগ্রিক গরুর মাংস রপ্তানির এক-পঞ্চমাংশ।
ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠী কর্তৃক গরু জবাই সাম্প্রদায়িক হিন্দু জনগোষ্ঠী যখন ধর্মের অবমাননা হিসেবে দেখছেন ঠিক তখন অসাম্প্রদায়িক হিন্দু জনগোষ্ঠী এটি নিধন পরবর্তী এর মাংস রপ্তানিকে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়ন ও দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে দেখছেন। ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে দাবিদার রাষ্ট্রে এ ধরনের বৈপরীত্য একদিকে অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক অপরদিকে সংবিধান স্বীকৃত ধর্মের স্বাধীনতার পরিপন্থী। সুতরাং যেকোনো রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হলে সেটিতে সাম্প্রদায়িকতার যেকোনো ধরনের প্রশ্রয় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি শুধু বিনষ্টই করে না করং এটিকে আরও উস্কে দেয়।
রশঃবফবৎধযসবফ@ুধযড়ড়.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান