পদ্মা সেতু কিংবা সড়ক প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি : একটি আত্মসমালোচনা
রেজওয়ান তানিম
অদ্ভুত এক দোষারোপের সংস্কৃতি এদেশে চলছে যাতে কোনো বিষয় বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের না করে আবেগে ঢালাও মন্তব্য করা হয়Ñ পুলিশ মানেই ঘুষখোর, ডাক্তার মানেই কসাই কিংবা ইঞ্জিনিয়ার মানেই চোর এ রকম একদিকদর্শী মতামত। পেছনে সবটাই অসৎ উদ্দেশ্য এমন বলা ভুল কেননা দেখা গেছে সাহসী সাংবাদিকতা কিংবা গণসচেতনতা অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ লোকদের চিহ্নিত করছে। সাম্প্রতিক হাওরের বাঁধে ঘটে যাওয়া দুর্নীতি এর প্রমাণ। সড়ক ও জনপদ বিভাগের কাজগুলোর অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বছর ঘুরতেই রাস্তার ভগ্নদশা জনমনে ক্ষোভ সঞ্চার করে। কিন্তু সাধারণ রাস্তা তৈরি কিংবা সামান্য বক্স কালভার্ট সেতু তৈরির মতো বিষয় নয় পদ্মা সেতু। এ এক মেগা প্রজেক্ট, যার অভিজ্ঞতা দেশে খুব একটা নেই। একজন লোকের সব বিষয়ে ধারণা থাকা অসম্ভব, আর তাই সব বিষয়ে গড়পড়তা মন্তব্য কিংবা এ চর্চাকে উৎসাহিত করা উচিত নয়। আজকাল সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারের যুগে এটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। সবচেয়ে সাম্প্রতিক শোনা যাচ্ছে ভারতের আসাম রাজ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা নদীর উপর সাড়ে নয় কি.মি. দীর্ঘ সেতু, দৈর্ঘ্যরে তুলনায় যার খরচের পরিমাণ নিতান্তই কম, মাত্র বারোশত কোটি টাকার কাছাকাছি। আসাম ও অরুণাচলের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টিকারী এ সেতুর সঙ্গে পদ্মা সেতুর খরচ ও আকার আকৃতির তুলনা নিতান্ত অজ্ঞের কাজ। কেননা এতে রেলপথ নেই, প্রস্থে মাত্র দুই লেন এমনকি এর দুই পিলারের মাঝের দূরত্ব মাত্র ৫০ মি.। শুধু দৈর্ঘ্য বেশি বলে ব্রহ্মপুত্রের শাখানদী লোহিতের সঙ্গে কোনোক্রমেই পদ্মা সেতু ও নদীর তুলনা হতে পারে না।
পদ্মা সেতুর অবকাঠামোর দিকে তাকালে দেখা যাবে দ্বিতল এ সেতু ৬.১৫ কি.মি. দীর্ঘ, চার লেন সড়কপথের প্রস্থ ৬০ ফুট আর নিচে রেলগাড়ি চলার একমুখী ব্রডগেজ পথ। এর স্প্যান (সেতুর দুই স্তম্ভের মধ্যবর্তী দূরত্ব) দৈর্ঘ্য ১২০ মি. থেকে সর্বোচ্চ ১৮০ মিটার যা অনেক বড় উপরোক্ত সেতুর তুলনায়। সেতুটি শুধু মাত্র যান চলাচলের জন্যেই নয় বরং এ থেকে গ্যাস পাইপলাইন, হাই ভোল্টেজ পাওয়ার লাইন এবং টেলিযোগাযোগ লাইন যাবার কথা রয়েছে। বহুমুখী এই সেতু হয়ে গেলে আশা করা হচ্ছে, তা আমাদের জিডিপির বৃদ্ধি ১-২% বাড়িয়ে দেবে। এখন খোলা চোখে মনে হতে পারে আমাদের খরচ এত বেশি কেন? এখানে কি দুর্নীতি খুব ব্যাপকহারে চলছে, সোজা বাংলায়, লুটপাট। বিষয়টি নিয়ে ঢালাও মন্তব্যের আগে ভাবা দরকার বাংলাদেশের মাটির গঠন ও চরিত্র। অনেকের জানা নেই বাংলাদেশের ভূমিরূপ যা আজকের দিনে আছে তা মাত্র একলক্ষ বছর পূর্বে হিমালয় ও অন্যান্য পাহাড়শ্রেণি থেকে বয়ে আসা মিহি মাটিময় পলি জমে জমে গড়ে উঠেছে। ভূ-তাত্ত্বিক বয়স অনুযায়ী বাংলাদেশ সদ্য ভূমিষ্ঠ নবজাতক যা এখনো বেড়ে উঠছে।
পৃথিবীর বৃহত্তম বেসিন এর গঠন এমনভাবে প্রকৃতি করেছে যে এখান থেকে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের জল বঙ্গোপসাগরে নামে। কি পরিমাণ পলি বয়ে আনে এ জল তার উদাহরণ হতে পারে এটিÑ এক বছর যদি মেঘনা নদীর পলি আটকানো যেত সমগ্র বাংলাদেশের উচ্চতা অন্তত দশ কিংবা তার অধিক ফুট বেড়ে যেত। এ রকম দেশ সারা পৃথিবীতে বিরল। যে মাটি কৃষিকাজের জন্য আদর্শ সে মাটি নির্মাণযজ্ঞের পক্ষে ততই খারাপ। একটি বন্যা উপদ্রুত ও পলল মাটির নদীর তলদেশের মাটি খুব মিহি যার প্রধান অংশ ংরষঃু পষধু। এই মাটির যেকোনো ধরনের ভারবহন ক্ষমতা আশ্চর্য রকম কম। যমুনা নদীর তলায় ষাট মিটার নিচে তবু শক্ত পাথরের স্তর মিলেছে যেখানে সেতুর ফাউন্ডেশন হতে পারে কিন্তু পদ্মায় শতাধিক মিটারেও তা মেলেনি। আমরা যদি যমুনা ব্রিজের অভিজ্ঞতা দেখি, সেখানে নদী প্রশিক্ষণ এবং পাড় বাঁধানোর যে বাঁধ তার ঢাল বা সেøাপ শুরুতে অনেক বাড়িয়ে ধরা হয় ১: ২.৫ অর্থাৎ এক ফুট উঁচু হলে আড়াই ফুট প্রস্থে হবে। বিশ্বে খুব কম নদীতেই এত ঢাল দেওয়া হয়। তবুও তা ভেঙে গেল, কেন গেল তার কোনো জবাব বিদেশি বিশেষজ্ঞ প্যানেল দিতে পারলেন না। এরপর বুয়েটের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষায় দেখা গেল মাটিতে আছে মাইকা নামের একধরনের উপাদান, যা মাটির দুই স্তরের মাঝে থাকে এবং এটি আড়াআড়িভাবে কোনোরকম চাপ নিতে সক্ষম নয়, তাই ভেঙে পড়ে। এই অবস্থা দূর করতে ১:৩ এবং শেষ পর্যন্ত ১:৫ এই সেøাপ দেওয়া হয়, যা বিশ্বে আর কোনো দেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই। সেই হিসেবে বিশ্ব রেকর্ড। এই একটি কারণেই প্রজেক্টের খরচ কত বেড়ে গিয়েছিল যারা পুরকৌশলের সঙ্গে যুক্ত নন, তাদের ধারণা করা কঠিন। এমনকি সমুদ্র সেতুর বেলাতেও পাড় বাঁধাতে অনেক সময় এত ঝামেলা পোহাতে হয় না। বুয়েটের প্রাক্তন ভিসি অধ্যাপক এ এম এম শফিউল্লাহ আমাদের এসব পড়িয়েছিলেন। যমুনার চেয়ে পদ্মা সেতুতে চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি সেটির কিছু কারণ উল্লেখ করা দরকার। যমুনা কিংবা পদ্মা এসব নদীর গভীরতা অনেক বেশি, যা বিশ্বে অনন্য। নদীর স্রোত ও তীব্রতায় পদ্মা বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম খরস্রোতা নদী। এ নদী মিনিটে পানির প্রবাহ এত বেশি যা সংখ্যা শুনলে বোঝা মুশকিল। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এক সহজ ব্যাখ্যা দিয়েছেন এ রকম যে এই পানি প্রবাহের ২০ সেকেন্ডের পানি যদি আটকানো যেত, তবে ঢাকা শহরে এক কোটি ৬০ লাখ লোকের একদিনের খাওয়ার পানির বন্দোবস্ত হতো। আমাজনের পরেই পদ্মায় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পানির প্রবাহ। এখন নদীর গলায় সেতুর শৃঙ্খল পড়াতে যে পাইল ব্যবহার হবে তা কত দীর্ঘ সে বিষয়ে আসা যাক। পাইলের সবচেয়ে দীর্ঘ ও গভীরতম অংশটি প্রায় ১২২ মিটার অর্থাৎ প্রায় চল্লিশতলা সমান একটি বাড়ির উচ্চতা নদীর তলায় গেঁথে দেওয়া হচ্ছে। এই দীর্ঘ পাইল কিন্তু একটি নয় যার উপরে পিলার হবে। যে অংশ মাটির নিচে থাকছে পাঁচ কিংবা ছয়টি একত্র করে তার উপরে একটি পিলার হচ্ছে, এর কারণ পদ্মার ভাঙন। নদীতে কি পরিমাণ স্কাউরিং বা নদীর তলদেশের ভাঙন হয় তা আমরা কখনোই খোলা চোখে দেখি না। এর ভয়াবহতা কোনোভাবে চিত্র ধারণ করা গেলে লোকে চমকে যেত। ভরা বর্ষায় এক ধাক্কায় এক মিনিটে ১০০ ফুট একবারে ক্ষয়ে যেতে পারে। যে অংশ ক্ষয়ে যাবে সেই অংশ আবার অন্য অংশে গিয়ে জমবে। নদীর তলদেশের ভাঙা-গড়ার খেলার মাঝে পিলারগুলো ঠিকমতো যাতে দাঁড়িয়ে থাকে সেজন্য যে বিপুল ব্যবস্থা নিতে হবে, ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমের সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের ধারণাতে নেই। আজকের দিনে যদি যমুনা ব্রিজের কথা চিন্তা করি, যেখানে এখন যমুনা ব্রিজ দাঁড়ানো তা নির্মাণকালীন সময়ের সবচেয়ে গভীর অংশ, তা শুধুই বিস্তীর্ণ চর। মিয়ান্ডারিং বা বিনুনি নদী এমনই, এগুলো আসলে মহিলাদের বেণীর মতো, দেখবেন দুপাশের চুল যত শক্ত করে বাঁধুন না কেন মাঝে কিছু ফাঁকা জায়গা থাকে, দুপাশের চুল নদীর জল হলে মাঝের ফাঁকা জায়গা চর। এই নদী এপাশে গড়ে, ওপাশে ভাঙে আবার গড়ে। ব্রিজের দুই পাড়ের সংযোগ সড়ক থেকে গোটা সেতুর ভবিষ্যৎ তো নদীর মর্জির উপরে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এই নদীকে বশে আনতেই প্রায় ১৩০০০ কোটি টাকার উপরে খরচ পড়ে যাচ্ছে, যা অন্য অনেক দেশেই করতে হয় না। যমুনা নদীতে ৬৫ মিটার গভীরে শক্ত পাথরের স্তর পাওয়া গিয়েছিল যেখানে পদ্মায় ১০০ মিটারের নিচে শক্ত পাথরের স্তরের দেখা মেলেনি। (চলবে-০১)
লেখক: প্রকৌশলী ও ভূতত্ত্ব গবেষক