হাওরের মানুষেরা কি উন্নয়ন অংশীদার হতে পারছে?
মো. আবদুল কুদ্দুস
আমরা জানি, ১৭৬২ সালের এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে সিলেটের হাওর ও মধুপুরের … তৈরি হয়েছে। এর দুইশত বছরেরও বেশি সময় পর স্বাধীনতার পরে এ অঞ্চলসমূহ বাংলাদেশের ভূ-খ-ের অন্তর্ভুক্ত হয়। সৃষ্টির পর থেকেই এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। আবার প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে এখানকার মানুষের শরীরের গঠনও ভিন্ন। ওখানকার কৃষি ও মৎস্য সম্পদ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। কিন্তু আজ অবধি এ অঞ্চলের উন্নয়ন তেমনভাবে দেখা যায়নি। কেবলমাত্র যখন এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে তখন এ এলাকার মানুষের কথা উঠে আসে। আলোচনা-সমালোচনা হয়। সময় শেষ হলে আবার সবাই সব ভুলে যায়। সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দুইশত মানুষের জন্য সাহায্যের পসরা বসালে সেখানে হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘ লাইন আভাস দেয় যে, হাওর অঞ্চলের মানুষের অভাব, কষ্ট-দুঃখ শুধু আকস্মিক বন্যার কারণে নয়। এ এলাকার মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে এর সৃষ্টির পর থেকে এমনকি স্বাধীনতার পর থেকে কোনো কাজ হয়নি! কার্যত কোনো উন্নয়ন হয়নি বলেই ওই এলাকার মানুষের ত্রাণ গ্রহণের হার এত বেশি। উন্নয়ন হলে মানুষের এত দীর্ঘ লাইন হতো না। কারণ মানুষ তার সম্মানবোধ থেকে হলেও সহজে কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণের সামগ্রী গ্রহণ করতে চাই না! হাওরের মানুষেরও অন্য কোনো উপায় থাকলে দুইশত মানুষের জায়গায় হাজার হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়াত না।
প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন (২৮ এপ্রিল, ২০১৭) মারফত জানতে পারলাম, শ্রমজীবী মানুষের এক করুণ পরিণতির কথা। সেদিনের শিরোনাম ছিল ‘শ্রমের হাটে অভাবী মানুষ’। যেখানে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা ডালি-কোদাল নিয়ে শ্রমের হাটে নিজেদরকে বিক্রি করার জন্য অসহায়ের মতো বসে অছে। তাদের পেটে খাবার নেই। আবার ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় শ্রমের ক্ষেত্র নেই। শ্রমের দাম নেই। এখন প্রশ্ন হলোÑ শুধু আকস্মিক বন্যাজনিত ফসলহানির কারণে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর অভাব-অনটন সৃষ্টি হয়েছে? না, তা আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না! এর পেছনের একমাত্র কারণ হলোÑ ওই এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে দীঘদিন যাবৎ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
মানুষের এত দুঃখ, এত কষ্ট! পিড়িত মানুষের আর্তনাদ! খাবার ও পানীয়ের অভাবে হাহাকার! অথচ আমার দেশের কিছু রাজনৈতিক নেতারা মানুষের এই কষ্ট-দুঃখকে পুঁজি করে রাজনীতি করছেন। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ‘ইউরেনিয়াম দূষণ’ রাজনীতিতে নেমেছেন। যেখানে ওই অঞ্চলের সাতটি জেলায় লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। মানুষের স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় আট লাখ টন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এক হাজারেরও বেশি টন মাছ মারা পড়ে নষ্ট হয়েছে। মারা গিয়েছে কয়েক হাজার হাঁস। সেটি কি কারণে হয়েছে তা নির্ণয়ে যখন বিশেষজ্ঞ টিম কাজ করছে এমন সময় কিছু জ্ঞানপাপীর দল হাওরের দুর্যোগ নিয়ে নানারকম মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন। বিএনপির এক নেতা মিডিয়াতে বলে দিলেন, বিশেষজ্ঞ টিমের প্রতিবেদন বিশ্বাস করা যায় না। হাওর এলাকার মাছ ও হাঁস মারা গেছে ভারত থেকে পানির সঙ্গে বয়ে আসা ইউরেনিয়ামের বিষক্রিয়ার প্রভাবে। ঘটনা যাই হোক, তাদের কাছে যদি তার প্রমাণ থাকত তবে দেরি না করে দুর্ঘটনা প্রশমনে সরাসরি মাঠে নেমে পড়াটাই উচিত ছিল। তর্ক-বিতর্ক পরে করা যেত। তাহলে দেশের মানুষের এত বিশাল ক্ষতি হতো না। সে কাজগুলো না করে ঢাকায় এসি ঘরের দলীয় কার্যালয়ে বসে শুধু সংবাদ সম্মেলন করলেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর হবে না। নিজেদের বিশেষজ্ঞ লোকবল নিয়ে কাজে নেমে পড়লেই জনগণের আস্থা আরও দৃঢ় হতো।
দেশের সংবাদমাধ্যম দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এ বিষয়ে রেখেছে রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভের’ সঠিক ভূমিকা। যথাসময়ে তারা হাওর এলাকার দুর্যোগের খবর প্রচার করে, মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ করে বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরে বিবেকবান মানুষের সেবার মনকে জাগ্রত করেছে। সরকার গণমাধ্যমের এসব প্রতিবেদন দেখে সময়মতো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে দুর্যোগ প্রশমন ও সাহায্য সংক্রান্ত সরকারি কমকা-ের ভূমিকা প্রসংশনীয়। তাছাড়া হাওর এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে মানুষের বাঁধ নির্মাণের প্রচেষ্টাকে জানাই ধন্যবাদ।
লেখক: শিক্ষক, বিজনেস স্টাডিজ বিভাগ ও সহকারী প্রক্টর, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী
সম্পাদনা: আশিক রহমান