কাসেম বিন আবুবাকারকে বর্জন বা গ্রহণ নির্ভর করে কার উপর?
শেখ মিরাজুল ইসলাম
খুব সম্প্রতি একটি টিভি-চ্যানেলে সাংবাদিক নঈম নিজামের সঞ্চালনায় ইসলামী ভাবধারার লেখক কাসেম বিন আবুবাকারের সাক্ষাৎকার দেখলাম। চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হলো। আমি নিজে তার লেখা আগে পড়িনি। এটাও জানতাম এই ঘরাণার বই যারাÑ রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মানিক, বিভূতি, শংকর, সমরেশ, সুনীল, বাসার, শীর্ষেন্দু, হুমায়ূন, ইলিয়াস,মিলন, সাবের, তসলিমা ইত্যাদি পড়ে বড় হয়েছেন তাদের ঘরাণায় পড়ে না।
কাসেম বিন আবুবাকারের বই কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মুসলমান সমাজের বাইরেও জনপ্রিয় বিধায় কিংবা তার ভাষায়, অলংকরণ ও ভাষার ভেষজগুণের ঘাটতি থাকায় হাসাহাসি করে লুটিয়ে পড়তে হবে সেটাও আমার বিবেচনায় ছিল না। আমার বিবেচনায় ছিল, তিনি সমাজে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়াচ্ছেন কি না? তার লেখায় ধর্মের আচার সম্পর্কে ভুল বার্তা পৌঁছাচ্ছে কি নাÑ যা এ সমাজকে আরও পিছিয়ে দিতে পারে। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত লেখকের ‘ফুটন্ত গোলাপ’ নিয়ে এখন আমরা কড়াই গরম করছি। কি আছে এতে তা জানতে গিয়ে অনেক মিশ্র তথ্য জানতে পারছি এখন।
আবুবাকারের ব্যাপারে অভিযোগ আছে, হিজাবি প্রেম আর ধর্মের কেতাবি কথা গল্পের ছলে তিনি পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে গিয়ে সমাজে ধর্মান্ধতার আমদানি করছেন। ধর্মের নীতিকথার আড়ালে আছে অবাধ প্রেমের রসদ। তার উপন্যাসে যৌন সুড়সুড়ির মাত্রা ভিন্নভাবে মাদ্রাসা পড়ুয়াদের মনে দানা বাঁধছে ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে আমার মনে হয়েছে, আবুবাকারের লেখা নিয়ে অতিকথন করা হচ্ছে। তিনি কোন ঢং-এ, কোন শ্রেণির পাঠকদের আকৃষ্ট করতে নিজের কোন দর্শনকে উপস্থাপন করবেন এটা সম্পূর্ণ তার ব্যাপার। সমাজ যদি হেজাব পছন্দ করে, রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেই যদি মদিনা সনদের বাস্তবায়নে উৎসাহিত হয় সেক্ষেত্রে এককভাবে আবুবাকারকে বলির পাঠা বানিয়ে তাকে হাস্যরসের পাত্র বানানো ‘সুশীল কর্ম’ নয়। এমন তো নয়, সমাজ বিচ্ছিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি লিখছেন। তার চেয়ে বড় কথা এই সমাজ নির্মাণে আমাদের প্রত্যেকের ভূমিকা আছে। ভোট আর বিভক্তির রাজনীতিকে ইস্যু করে সেই সমাজের উত্থান। আবুবাকার তারই বয়ান করেছেন তার সীমাবদ্ধ চিন্তা-যুক্তিতে। এই বৃত্তের বাইরে যারা ‘মুক্তচিত্তে’ বাস করছেন তাদের ওজনদার কথামালায় ঢাকা পড়ে গেছেন তারা নিজেরাই। এটাই কদর্য সত্য। তাছাড়া আবু বাকার যখন তার সাক্ষাৎকারে জোর গলায় বলেন, তিনি হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাই মনে করেন, সাম্প্রদায়িকতা দেখলে কষ্ট পান, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের একটি বই আঠারো বার পড়েছেন কিংবা নীহারঞ্জন গুপ্ত তার প্রিয় লেখকÑ তখন বুঝে নিতে হয় নিজের সীমাবদ্ধতা থাকলেও তিনি জনপ্রিয় হওয়ার সূত্রটি ঠিকই বোঝেন। ধর্মের আচার তার লেখার লেবাস। এর ভেতরের সুড়সুড়ি তার ভাষায় সমাজের বাস্তবতা। সেটি কালিমা ও সেই কালিমাগুলো ঢাকার জন্যই একটা গল্প বলার চেষ্টা তার। সোজা ভাষায় বললে, কথিত লিটনের ফ্ল্যাটে কি হয় সেটি তিনি জানেন ও লেখায় তা প্রকাশ করেন। পাশাপাশি সেখানে যেতে মানাও করেন। সেটি ভাষার উপমা-সুষমায় আর কাহিনী বিস্তারে লিও তলস্তয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর হলো কি না সেটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা থাকতে পারে, কিন্তু তার নেই। তিনি দলিল লেখক, নাকি চটি লেখকÑ সেটা নিয়ে আমরা রাতভর তর্ক করে তাকে জাত লেখকের পদবাচ্যে না বসালে তার নিজস্ব পাঠক সংখ্যা মোটেও কমবে না? একসময় বঙ্কিমচন্দ্রকেও সাম্প্রদায়িক লেখক হিসেবে তুলনা করা হতো। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তার অবদান কি খাটো হয়েছে?
সময় ও সমকালীন সমাজ একজন লেখকের কলমকে ক্ষেত্র বিশেষে নিয়ন্ত্রণ করে। কলমের খোঁচায় সেই লেখকের পরিচয় বাম হতে ডানে ঘুরে যেতে অতীতে অনেকবার আমরা দেখেছি। কিন্তু আবুবাকার যা লিখেন তা নিয়ে চটুল হাসিঠাট্টায় শরিক হওয়ার আগে সচেতন পাঠক সমাজ বরাবর জানতে ইচ্ছে করে, কেন তবে আপনাদের প্রিয় লেখকগণ কেবলমাত্র লেখালেখি অবলম্বন করে এই সমাজে ভদ্রস্থভাবে বেঁচে থাকতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন? কেন প্রিয় লেখকের বই না কিনে ফাস্টফুডের দোকানে হাজার টাকা বিল দেন? গার্লফ্রেন্ডকে বই উপহার না দিয়ে আইফোন গিফট করেন? সন্তানের হাতে বই তুলে না দিয়ে বাণিজ্য মেলায় গিয়ে গুচ্ছের প্লাস্টিকের জিনিস কিনে ঘর ভর্তি করেন? ছুটিতে বই না পড়ে হাওরে-বাদাড়ে পাখি শিকার করে আমোদে মাতেন?
সে তুলনায় ‘স্বল্প শিক্ষিত’ আবুবাকারের পাঠকগণ অনেক বেশি কমিটেড, আন্তরিক ও সৎ তাদের প্রিয় লেখকের প্রতি। আবুবাকার তাদের মাঝেই বেঁচে আছেন। আমাদের সুশীল সমালোচনার জবাব দিতে কাসেম বিন আবুবাকারে আপাতত দায় নেই। আমরা যত বেশি বলতে থাকব, তার পাঠকেরা আরও তত বেশি শতশত ‘পাহাড়ী ললনা’, ‘অবাঞ্ছিত উইল’ কিনতে ও পড়তে থাকবেন। তবু বই পড়ুনÑ এই এলিট সেøাগানে যারা বিশ্বাসী তারা এরপরও কি করে অন্যকে বলেন, আবুবাকার পড়বেন না? কাউকে কিছু পড়তে মানা করা কি অন্যায় নয়? সাহিত্য রুচি অনেকটা খাদ্যাভ্যাসের মতো। যার যেটায় রুচি। একেই বোধহয় বলে সাক্ষাৎ ব্যুমেরাং। আবুবাকারকে গ্রহণ কিংবা বর্জন তা নির্ভর করে যার যার সাহিত্য রুচির ওপর। আর এই রুচি তৈরির কারিগরদের দায় আম-পাঠকদের উপর চাপানো ঠিক না। এই বিব্রতকর পরিস্থিতি সম্ভবত আমাদের পাওনা ছিল।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান