চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন গ্রিড বিপর্যয়ে বিদ্যুৎহীন অর্ধেক দেশ
হাসান আরিফ : ঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত একটি সঞ্চালন লাইন মেরামতের মধ্যেই জাতীয় গ্রিডের আরেকটি সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাট দেখা দেয়। এতে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ জনপদের অন্তত ৩২ জেলার মানুষকে ২ থেকে ৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকতে হয়েছে। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী জানিয়েছেন, জাতীয় গ্রিডের আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ ও ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইনে ত্রুটির কারণে রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের ৩২ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিকাল নাগাদ বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
পিজিসিবির সহকারী ম্যানেজার (জনসংযোগ) এবিএম বদরুদ্দোজা খান জানান, ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী সঞ্চালন লাইনে মঙ্গলবার বেলা ১১টা ২০ মিনিটে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিভ্রাট দেখা দেয়। ফলে পিজিসিবির রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল জোনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেসব এলাকার সব বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদনও থেমে যায়। এরপর এলাকা ভেদে দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ২ হাজার ২৪৯ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার মোট ২৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া আন্তঃদেশীয় গ্রিড লাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হয়ে। পিজিসিবির ওই চার জোনে মোট ৩২টি জেলা রয়েছে, যেখানে দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বসবাস। এর বাইরে ঢাকা জোনের জেলা ফরিদপুরসহ আরও কয়েকটি স্থানে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকার খবর পাওয়া গেছে।
দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ জনপদের জেলাগুলোর বাসিন্দাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। হাসপাতাল ও জরুরি সেবাকেন্দ্রগুলোকে নির্ভর করতে হয় জেনারেটরের ওপর। এলাকা ভেদে বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎ এলেও সরবরাহ কম থাকায় ওই সব এলাকায় লোড শেডিং চলছিল।
যেভাবে বিপর্যয়
আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এমডি সাজ্জাদুর রহমান জানান, কালবৈশাখী ঝড়ে সোমবার রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার কালীপুরে একটি বিদ্যুতের টাওয়ার ভেঙে পড়ে ২৩০ কিলোভোল্টের সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ পাঠানোর জন্য দুটি ২৩০ কেভির লাইন আছে। একটি আশুগঞ্জ থেকে সিরাজগঞ্জে, আরেকটি ঘোড়াশাল থেকে ঈশ্বরদীতে।
২৩০ কেভি লাইন হাই ভোল্টেজ সঞ্চালন লাইনের মধ্যে পড়ে। সারাদেশে পিজিসিবির ৩ হাজার ১৮৫ সার্কিট কিলোমিটার ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন রয়েছে। আশুগঞ্জের ওই লাইন মেরামত করার মধ্যেই মঙ্গলবার বেলা ১১টা ২০ মিনিটে ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী সঞ্চালন লাইন ট্রিপ করে।
ঝড়ে আশুগঞ্জ থেকে সিরাজগঞ্জ লাইনের টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ঘোড়াশাল থেকে ঈশ্বরদী লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এ লাইনটি ওভারলোডের কারণে ট্রিপ করে। ফলে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওয়েস্টার্ন গ্রিড আমাদের ইস্টার্ন গ্রিড থেকে আলাদা হয়ে যায়। ফলে ওই এলাকার প্রায় সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু করতেও কিছুটা বিদ্যুৎ লাগে। আবার কোনো কারণে কোনো সঞ্চালন লাইনে লোড বেড়ে গেলে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। ফলে কোনো কারণে কোনো কেন্দ্র বা সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো সিস্টেমে সরবরাহের ঘাটতি তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে কিছু এলাকা বিদ্যুৎহীন রেখে অথবা অন্য কোনো গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ এনে লোড সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তা করা না গেলে অর্থাৎ লোড সমন্বয় না হলে অন্য কেন্দ্রগুলোর ওপর চাপ বাড়ে। এভাবে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেনারেটর বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর নতুন করে কোনো কেন্দ্র বন্ধ হলে সরবরাহে ঘাটতি আরও বাড়ে এবং একইভাবে অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রও বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এর আগে ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা সঞ্চালন কেন্দ্রে বির্পযয় দেখা দিলে ভারতের সঙ্গে সঞ্চালন লাইন বন্ধ হয়ে যায়। জাতীয় গ্রিড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ভারতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রক্রিয়া। একই সময় দেশের উৎপাদনে থাকা সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র একযোগে বন্ধ হয়ে গেলে, ধস নামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। ফলে সারা দেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দেয়।
বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে তদন্ত কমিটি
সঞ্চালন লাইনে সমস্যা দেখা দেওয়ায় দেশের অর্ধেক জেলায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পিজিসিবি। এ প্রতিষ্ঠানের সহকারী ম্যানেজার (জনসংযোগ) এ বিএম বদরুদ্দোজা খান জানান, তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পাঁচ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। পিজিসিবির প্রধান প্রকৌশলী (ট্রান্সিমিশন-২) মো. কামরুল হাসান এ তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দেবেন।