‘হয়তো এবার কেশাগ্র স্পর্শ করা যেতে পারে’!
দীপক চৌধুরী
ধান মাছের পর মাথা গোঁজার ঠাঁইও গেছে হাওরবাসীর। দুর্যোগ-দুর্ভোগ যেন পিছুই ছাড়ছে না সুনামগঞ্জের ফসলহারা মানুষের। গত রোববার রাতের কালবৈশাখীর তা-বে বিধ্বস্ত হয়েছে বহু বাড়িঘর। ত্রাণবাহী চালের নৌকা ডুবেছে। সবচেয়ে বেশি অবহেলিত কৃষক। কিন্তু দেশে সবচেয়ে বেশি তাদের সংখ্যা। প্রতিটিক্ষেত্রে তাদের ঠকানো হয়। পাউবোর প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে এবার। আগাম বন্যায় প্লাবিত সুনামগঞ্জ জেলার হাওর রক্ষা বাঁধের নির্মাণ ও সংস্কার কাজে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ধীরগতি সংক্রান্ত গুরুতর অভিযোগ তদন্তের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের তিন প্রকৌশলীকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হলেন সিলেটের পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল হাই, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম সরকার এবং সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আফসার উদ্দীন। আদেশে বলা হয়েছে, হাওর রক্ষা বাঁধের নির্মাণ ও সংস্কার কাজে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ধীরগতির ‘গুরুতর অভিযোগ তদন্তের স্বার্থে’ তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে।
এবার তিনজন প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করায় সুনামগঞ্জের কালিবাড়ি এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী মন্তব্য করলেন, ‘এবার হয়তো তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করা যাবে।’ দুদিন আগে ক্ষোভে দুঃখে তারা অনেকে বলেছিলেন, প্রায় বছরই নানারকম অনিয়ম দুর্নীতি হয়। কিন্তু সঠিক তদন্ত হয় না, বিচার দূরের কথা। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে এখনো কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। জাতীয় আয়ে কৃষির অনুপাত অনেক কমে এলেও দুই কোটির বেশি নারী-পুরুষ কৃষির সঙ্গেই যুক্ত। গার্মেন্টসসহ ছোট-বড় সব কারখানার হিসাব ধরলে শিল্পশ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭২ লাখ। অর্থনীতির গতির ধরনের কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সম্প্রসারণ বাড়ছে আর বাড়ছে তাতে যুক্ত মানুষের সংখ্যা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকানে কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যা এখন প্রায় ৮৫ লাখ। রিকশাভ্যানসহ পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিক। নির্মাণশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০ এপ্রিল অর্ধেক কৃষিঋণ মওকুফের কথা বলে এসেছেন। সরকারিটা না হয় মানা গেল কিন্তু মহাজন ও এনজিওদের ঋণ দিতে হচ্ছে। এখনই গলাটিপে ধরেছে তারা। প্রায় ৮ লাখ হাওরবাসী দুর্ভোগে পড়েছেন এবার। প্রবীণ কৃষকদের মতে, গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এমন দুর্ভোগে কৃষকদের পড়তে হয়নি। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, শুধু সুনামগঞ্জ হাওরে অকালবন্যায় এ পর্যন্ত ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আইদুল্যা মিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য নিয়ে শাল্লা এসে হাওরবাসীর প্রকৃত দুর্ভোগ দেখে গেছেন এবং কেউ না খেয়ে মারা যাবে না এটাও নিশ্চিত করেছেন। সুতরাং সরকারি সাহায্য ও ত্রাণ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সঠিকভাবে বণ্টন করা হলে প্রকৃত উপকার পাবে মানুষ। তা না হলে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষীদের কপাল খুলবে। বিশেষ করে জরুরিভিত্তিতে শিক্ষিত তরুণদের এখনই ডিলার নিয়োগ করতে হবে। উপজেলার ভাইটগাঁয়ের মুক্তিযোদ্ধা সুকলাল দাস রায়ের মতে, এ বছরের মতো কখনো নিরুপায় হয়ে পড়েনি কৃষকরা। জরুরিভিত্তিতে নতুন ডিলার নিয়োগ দরকার। এই সাহসী মুক্তিযোদ্ধা উচ্চারণ করলেন, ৩০ তারিখ (৩০ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সঙ্গীসাথী নিয়া আমরারে দেকতে শাল্লা এসেছেন, তাইন (তিনি) কিতা কইছন মানুষ হুনছে।
দিরাই উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, শুধু পুরনো ১৫ জন ডিলার এখন কাজ করছে, নতুন ডিলার এখনো নিয়োগ করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ১১টি উপজেলায় এখনো নতুন ডিলার নিয়োগ করা হয়নি। তাহলে ক্ষুধার্ত কৃষক ও ক্ষত্রিগ্রস্তরা চাল বা আটা পাবে কীভাবেÑ এ প্রশ্ন অনেকের। ইউনিয়ন পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সাহায্য সঠিকভাবে সরবরাহ করার জন্য নতুন ডিলার নিয়োগ অতিপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেন। হাওরের ফসল হারিয়ে কৃষকেরা এখন নিঃস্ব, দিশেহারা। এর মধ্যে মমতাময়ী মায়ের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আবির্ভাব ও আন্তরিকতা নিয়ে কৃষকদের মনে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে তারা অনেকে এখন সন্দিহান সুবিধাবাদীদের নিয়ে। তথাকথিত জনপ্রতিনিধিরা কেউ কেউ এখন এই সুযাগটি নেবে। দিরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি আজিজুর রহমান বুলবুল তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘আমার তো মনে হচ্ছেÑ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুঃসময়ে কাছে পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মনোকষ্ট অনেকখানি কমেছে। তার আন্তরিক সহযোগিতা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হাওরবাসী মনে রাখবে বলে বিশ্বাস করি। তবে দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলোÑ সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ের সাহায্য-সহযোগিতায় ফসলহারা হাওরবাসীর দুঃখ-দুর্দশা কিছু মাত্রায় লাঘব হলেও আগামী বোরো মৌসুমের ফসল না ওঠা পর্যন্ত তাদের জীবনে অভাব-অনটন থাকবে। সরকারি সাহায্য সঠিকভাবে বণ্টন করতে হবে।’
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ফববঢ়ধশপযড়ফিযঁৎু১০@মসধরষ.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান