ক্ষুদ্র ঋণে আত্মকর্মসংস্থান : অসম্ভব সাধারণীকরণ
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির প্রসঙ্গটি নিয়ে আমাদের দেশে বহুবছর ধরেই কাজ হচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে কাজ হচ্ছে। এটাকে আজকাল আবার কেউ কেউ স্ব-উদ্যোগ বলেও অভিহিত করেন। তবে, যে নামেই ডাকা হোক না কেন মূল লক্ষ্য একটিই। আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিজে করাকেই আত্মকর্মসংস্থান বলে। প্রত্যেকে যেন চাকরির পেছনে না ছুটে বা চাকরির খোঁজ না করে সে জন্যই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির কাজটি করা হয়। অনেকে আবার এই ভাবনাটিকে গতিশীল করার জন্য নানা প্রকার সুপারিশও দিয়ে থাকে। তবে, বিষয়টি নিয়ে আমার একটু ভিন্নমত রয়েছে। কারণ, সবাইকে উদ্যোক্তা তৈরির চেষ্টা করার আগে বুঝতে হবে সকলে আসলে উদ্যোক্তা হতে পারবে কিনা। আবার, আমরা যেভাবে ঢালাওভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আহ্বান করি, বিভিন্ন প্রকার উপদেশ দিই সেটাও সকল দিক চিন্তা করে দিই কিনা তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। কারণ, যা আমরা বলি বা যা দেখতে চাই বাস্তবতা তার সঙ্গে অনেকটা ভিন্ন চিত্র প্রকাশ করে।
আজ থেকে প্রায় বিশ পঁচিশ বছর আগে বাংলাদেশে আয়ারল্যান্ড ভিত্তিক কনসার্ন নামক একটি এনজিও মূলত দুস্থ মহিলাদের নিয়ে কাজ করত। দুস্থ বলতেও সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় যারা ছিল তাদের নিয়েই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করত। এই তালিকার মধ্যে ছিল যারা স্বামীকর্তৃক বিতাড়িত, বিধবা, গৃহহীন, আশ্রয়হীন এবং যাদের সত্যিকার অর্থেই কোনোকিছু করার ক্ষমতা নেই এমন সব মহিলা। এই সকল মহিলারা ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনযাপন করত। ওই সময়ে কনসার্নের কিছু প্রকল্প আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছিলাম। ইউএনডিপির অর্থায়নে একটি গবেষণা প্রকল্প ছিল। আমি ওই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ফলে প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক কার্যক্রম আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল।
কনসার্ন নামের ওই এনজিও প্রতিষ্ঠানটি দুস্থ মহিলাদের তাদের সেন্টারে নিয়ে আসতো। কোনো মহিলার ছোট সন্তান থাকলে ওদেরকেও নিয়ে আসতো। তারপর কয়েক মাস ওই সেন্টারে রাখার ব্যবস্থা করত। এটি তিন মাস, চার মাস এমনকি বার মাসও হতো। এনজিওর পক্ষ থেকে দুস্থদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। বাচ্চাদের থাকা খাওয়ার পাশাপাশি পড়ালেখা শেখানো হতো। আর মহিলাদের বিভিন্ন প্রকার বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। চানাচুর বানানো, মুড়ি ভাজা, ঠোঙ্গা বানানো, বাঁশ ও বেঁতের পণ্য তৈরি, হাতের কাজ, কাঁথা সেলাইসহ আরও নানা রকম কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর ব্যবসা শুরুর জন্য মূলধনও দিত। তারপর তাদেরকে নিজ উদ্যোগে ব্যবসা করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে বলত। তখন তাদের আর ওই সেন্টারে রাখা হতো না। শুধু প্রশিক্ষণ ও মূলধন দিয়েই বিদায় করত না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের কাজ করার জন্য যে সকল যন্ত্রপাতি বা উপকরণ প্রয়োজন হতো সেগুলোও দিয়ে দিত। এতসব দেওয়ার পরেও এক বছর বা সর্বোচ্চ দেড় বছর পর তারা আবার তাদের আগের কাজে ফিরে যেত। আবার অধিকাংশই ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিত। অর্থাৎ, তাদের পক্ষে উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব হতো না। এই সময়ের মধ্যে তাদের যে মূলধন বা পুঁজি দেওয়া হতো তা শেষ করে ফেলত। প্রশিক্ষণ দিয়ে যে কাজটা শেখানো হয়েছিল শেষ পর্যন্ত সেটি আর করতে পারত না। তখন আমার পর্যবেক্ষণে যে বিষয়টি বেরিয়ে এসেছিল তা হলোÑ সকলকে মালিক বানানো সম্ভব না। উদ্যোক্তা মানেই অতি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান হলেও তিনি তার মালিক। তার কোনো কর্মচারী না থাকলেও তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক। মালিক হতে হলে একজন ব্যক্তির মধ্যে কিছু অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন যা সকলের মধ্যে থাকে না। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, বিচক্ষণতা, সাহসী, সৃজনশীলতা, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা, আর নিজে কিছু করার অদম্য ইচ্ছা না থাকলে তাকে মালিক বানানো যায় না। এ কারণেই কনসার্ন সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার পরও তারা মালিক হতে পারেনি।
আমরা তখন কনসার্নকে বলেছিলাম দুস্থ মহিলাদের জন্য কিছু করতে হলে সবার জন্য ঢালাওভাবে একই কাজ করা ঠিক হবে না। আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম টার্গেট গ্রুপকে সেন্টারে আনার পর তাদেরকে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করতে। যাদের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে, যারা সৃজনশীল মেধার অধিকারী, যারা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং নিজে কিছু করার মতো সাহস ও দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ধারণ করে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য। আর যাদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান নেই তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক উদ্যোক্তাদের অধীনে শ্রমিক হওয়ার জন্য। সকলকে উদ্যোক্তা তৈরির ভাবনাটি কখনো সফল করা সম্ভব না। (চলবে-০১)
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান