স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব
ইসমাঈল আনিস স্ত্রীকে পছন্দনীয় সুগন্ধি উপহার দেওয়া: যদি স্ত্রীর সুগন্ধি, আতর, পারফিউম ইত্যাদি পছন্দনীয় হয়, সুন্নত হলো স্বামী স্ত্রীকে সুগন্ধি কিনে উপহার দেবে। এটা অনেক বড় পূণ্যের কাজ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে স্বামী নিজের স্ত্রীর কাপড় ও অঙ্গে সুগন্ধি লাগিয়ে দেয়, সেই সুগন্ধির প্রভাব থাকার সময় অবধি একশোজন ফেরেশতা স্বামীর আমলনামায় পূণ্য লিখতে থাকে। যদি স্ত্রী নিজ অর্থ দিয়ে সুগন্ধি কিনে ব্যবহার করে, তাহলে শুধু স্ত্রীরই ছওয়াব মিলবে। স্ত্রীর সঙ্গে ভালোবাসাপূর্ণ ব্যবহার করা: সুখ-সুন্দর, স্বাচ্ছনদময় স্থায়ী বিবাহ বন্ধনের জন্য স্ত্রীর জীবনকে সর্বদিক দিয়ে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে মহব্বতকে মেকিতার খোসলমুক্ত রাখা, একে অপরের আবেগগুলোকে বোঝা এবং সেগুলোর স্বযতœ লালন করা চাই। ভালোবাসার আবেগি বুলি আওড়ানো উচিৎ। এতে পরস্পরের তনু-মন খুশিতে ভরে ওঠবে। রাসুল (সা.) বারবার হযরত আয়েশা রা.কে ভালোবাসাপূর্ণ বাক্যে সম্বোধন করতেন। ওহে আমার জান, ওহে আমার সুগন্ধি, ওহে আমার প্রিয়তমা, ওহে আমার সুখ- দু:খের সঙ্গী! ইত্যাদি বাক্য বলে বলে তাকে খুশি রাখার চেষ্টা করতেন। হাদিসে এসেছে যে ব্যক্তি স্ত্রীকে ভালোবাসাপূর্ণ বাক্যে সম্বোধন করবে, যার দ্বারা স্ত্রীর দিল স্পন্দিত হয়, কেয়ামতের চিন্তা- পেরেশানী হতে আল্লাহ তায়ালা তাকে মুক্ত রাখবেন। প্রতিশব্দের বিনিময়ে সাতশো বছরের মকবুল ইবাদতের ছওয়াব তার আমলনামায় লিখিত হবে। স্ত্রীর প্রাত্যহিক প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব হলে প্রতিদিনে একবার অন্যথায় সপ্তাহে অন্তত একবার করে হলেও ঘরোয়া আসবাবপত্রের খোঁজ-খবর নেওয়া। যেমন: বাজার, শাক-সবজি, চাল- ডাল, আটা, গোস্ত, মসলা, খাবার তৈরির পাত্র, বাসন-কোসন, গোসল-কাপড় ধোয়ার সাবান ইত্যাদি। প্রয়োজনমাফিক স্বামী নিজেই এগুলোর ব্যবস্থা করে দেবে। অন্যথায় স্ত্রীর হাতে টাকাকড়ি দিযে রাখবে, যাতে প্রয়োজনের সময় সে এগুলো কারো মাধ্যমে আনিয়ে নিতে পারে। একবার এক মহিলা রাসুল (সা.)-এর দরবারে এসে অভিযোগ করলো ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার স্বামী খুবই কৃপণশ্রেণীর লোক! আটা তৈরির পাত্রটি পর্যন্ত সে ব্যবস্থা করে দেয় না। উপরন্তু আমিও এমন কোন কাজ জানি না, যার মাধ্যমে ঘরোয়া প্রয়োজনগুলো পূরণ হয়। রাসুল (সা.) বললেন, এরূপ ধৈর্যধারনের ফলে তোমার জন্য জান্নাত নিশ্চিত। আর তোমার স্বামীর জন্য জাহান্নাম অবধারিত। প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সেবিকার ব্যবস্থা করা: স্বামী ধনী হলে স্ত্রীর খেদমতের জন্য সেবিকার ব্যবস্থা করা আবশ্যক। কেননা, কিছু বিশেষ কাজ ব্যতিত স্ত্রীর দায়িত্বে অন্যকিছু আবশ্যকীয় নয়। একব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর দরবারে এসে আরজ করলো— ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি দ্বিতীয় করেছি। কিন্তু এ স্ত্রী আমাকে রুটি পর্যন্ত বানিয়ে দেয় না। রাসুল (সা.) বললেন, যদি সে রুটি বানিয়ে না দেয় তাহলে তুমি তাকে রুটি বানিয়ে খাওয়াও। স্ত্রীর জন্য আলাদা কামরার ব্যবস্থা করা স্ত্রী যদি একান্নবর্তী পরিবার, জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাকতে স্বচ্ছন্দ না হয় তাহলে স্বামীর ওপর আবশ্যক হলো, স্ত্রীর বসবাসের জন্য এমন কোন বাড়ি কিংবা প্রশস্ত কামরার ব্যবস্থা করা, যেখানে স্ত্রীর অবস্থানের ক্ষেত্রে কোনপ্রকার কষ্ট অনুভব না হয়। এবং সেখানে দৈনন্দিন ব্যবহার্য আসবাবপত্রেরও ব্যবস্থা থাকে। মিলনেও যথাযোগ্য হক আদায় করা পরস্পর মিলন তিনদিন অন্তর অন্তর অবশ্যই হওয়া চাই। চারদিনের বেশি পৃথক থাকা অনুচিৎ। (বিশেষ মুহূর্তগুলোর ক্ষেত্রে ভিন্নকথা)। কেননা, প্রতিজন মুসলমানের ক্ষেত্রে শরীয়ত কর্তৃক বৈধ স্ত্রীর সংখ্যা চার। এর অধিক নয়। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি স্ত্রীদের সংখ্যার হিসেব অনুপাতে তাদের সঙ্গে মিলনাবদ্ধ হয়, সে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী ব্যক্তির ন্যায় ছওয়াবের ভাগীদার হয়। প্রয়োজনীয় মাসায়েল শেখানো স্বামীর কর্তব্য হলো, স্ত্রীকে নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত, হায়েজ-নেফাস ও অন্যান্য অতীব প্রয়োজনীয় মাসআলাগুলো শেখানো। নিজের জানা না থাকলে অন্যের থেকে জেনে শেখাবে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি স্ত্রীকে দীনের একটি মাসআলা শেখায়, আল্লাহ তায়ালা তার আমলনামায় আঠারো বছরের ইবাদতের ছওয়াব লিখে দেন। স্ত্রীর উপর কঠোরতা আরোপ না করা স্ত্রীকে কষ্ট দেওয়া, কোন বিষয়ে ত্যাক্ত-বিরক্ত করা এবং তার মন ভাঙ্গা একান্তই দোষনীয়। ফারায়েজ, ইবাদত, নামাজ, রোজা এবং অন্যান্য শরয়ী জরুরি বিষয় ব্যতিত অনর্থক তার উপর কঠোর হওয়া অনুচিৎ। কোন বিষয় প্রথমত অত্যন্ত নম্রতা, মহব্বতের সঙ্গে বোঝাবে। যদি সে মেনে নেয় এবং সঠিক পথে এসে যায় তাহলে আল্লাহর শোকর আদায় করবে। আর যদি না মানে তাহলে সামান্য কঠোর বাক্যে বোঝাবে। তবুও না মানলে অল্পমত রাগ দেখাবে, ক্ষোভ প্রকাশ করবে। এতেও যদি কাজ না হয়, সে নিজের খেয়াল-খুশিমতোই চলতে থাকে, নিজ ভ্রান্তিতে অনড় থাকে তাহলে এক্ষেত্রে সামান্য প্রহারের নির্দেশ রয়েছে। তবে, এমনভাবে প্রহার করা অনুচিৎ, যার দরুণ স্ত্রীর হাত-পা ভেঙ্গে যায়, কোন অঙ্গের ক্ষতিসাধন হয় এবং শরীরে আঘাতের চিহ্ন ফুটে ওঠে। বরং নেহায়েতই নামেমাত্র প্রহার করবে। এতোকিছুর পরও যদি স্ত্রীর বোধোদয় না হয়, নিজ গোড়ামিতেই অটল থাকে, তখন নিরূপায় হয়ে তালাকের পথ বেছে নেওয়ার অনুমতি রয়েছে। তবে, জানার বিষয় হলো, তালাকদান একটি অপছন্দনীয় বিষয়। এর বৈধতা তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন আল্লাহর বিধানাবলী, শরয়ী ফারায়েজমূহ এবং দীনি বিষয়ে স্ত্রীর অসন্তোষ প্রকাশ পাবে। শতোবার বোঝানোর পরও সে বুঝ না মানবে, কোন পরিবর্তন না হবে। বরং সে নিজ ভুলের উপরই অটল থাকবে। অন্যথায় দীনের সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন কোন দুনিয়াবি বিষয়ের জের ধরে তালাক দেওয়া নিতান্তই গর্হিত, অসমীচিন কাজ। ইসলামি শরীয়তে এর বৈধতা নেই। স্ত্রী যদি খাবার রান্না না করে, ঘর-দোর ঝাড়ু না দেয় এবং শিশুকে দুপান না করায় তাহলে এসকল বিষয়ে কঠোরতা আরোপ করা যাবে না। ভালোবাসার দিয়ে বোঝাতে হবে। কেননা, এসকল কাজকর্ম শরীয়তে ইসলামিয়া স্ত্রীদের উপর আবশ্যক করেনি। হ্যাঁ, স্ত্রী যদি নিজ খুশিতেই করে দেয় তাহলে ইহা তার উত্তমতা, সৎচরিত্র, উন্নত গুণাবলি এবং স্বামীর প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা-মহব্বতের লক্ষণ। স্বামীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বহি:প্রকাশ। অন্যথায় এসকল কাজ তো স্বামীর জিম্মায়ই আবশ্যক। এক সাহাবি রাসুল (সা.)-এর দরবারে এসে আরজ করলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমার স্ত্রী নামাজ পড়ে না। আমি তাকে বহুবার বুঝিয়েছি। অনেক নসীহত করেছি। এতেও কোন কাজ হচ্ছে না! রাসুল (সা.) বলেন, তুমি তার প্রতি অসন্তোস প্রকাশ করো। সাহাবি বললেন, আমিও তাও করেছি। এতেও কাজ হচ্ছে না। রাসুল (সা.) বললেন, তাকে প্রহার করো। সাহাবি বললেন, আমি তাকে প্রহারও করেছি। এতেও তার ভেতর কোনপ্রকার ভাবান্তর হচ্ছে না! রাসুল (সা.) বললেন, এবার তাহলে তুমি তাকে তালাক দিতে পারো। সাহাবি উক্ত স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিলেন। রাসুল (সা.) তার জন্য দোয়া করলেন যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে এক দীনদার, সম্পদশালী, সতি-সাধবী স্ত্রী দান করবেন।’ হাদিস বর্ণনাকারী বলেন যে, একমাস অতিবাহিত না হতেই এক দীনদার সম্পদশালী স্ত্রীর সঙ্গে উক্ত সাহাবির বিবাহ হয়ে যায়। এত্থেকে প্রতিয়মান হয় যে, শরযী কোন বিষয়ে অবহেলার কারণেই শুধু স্ত্রীকে তালাক দেওয়া বৈধ। দুনিয়াবী বিষয়ে তালাক দেওয়া অবৈধ এবং ধিকৃত, নিন্দনীয় কাজ। লেখক: শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ইন্ডিয়া।