রামপালের দূষণে ঢাকা ও কলকাতার শিশু ও বৃদ্ধরা আক্রান্ত হবে : গ্রিনপিস
বিরোধিতা আদর্শিক নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক : বিশেষজ্ঞ
উম্মুল ওয়ারা সুইটি : রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ক্ষতির দিক তুলে ধরে পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস বলেছে, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বায়ু দূষণে বছরে ৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হবে ও ৬০০ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মাবে। এছাড়া ঢাকা ও কলকাতার বাসিন্দারা, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা বায়ুদূষণে মারাত্মক আক্রান্ত হবে। অন্যদিকে বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই সরকার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ ডক্টরস হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে রামপাল বিদ্যুৎকন্দ্রের বায়ুদূষণের ফলে সম্ভাব্য ক্ষয়-ক্ষতির বিষয়ে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। পরিবেশ বিষয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সংস্থা গ্রিনপিস এর কয়লা ও বায়ু দূষণ বিশেষজ্ঞ লরি মাইলিভিরতার লরি স্কাইপের মাধ্যমে তার গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন। সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির অনুরোধে তিনি এই গবেষণাটি করেছেন বলে আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এ সময় বলা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্গমন স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যানসার, বয়স্কদের হৃদযন্ত্রের ও শ্বাসতন্ত্রের রোগের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের শ্বাস-প্রশ্বাসের উপসর্গের ঝুঁকি অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবে। গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতির বক্তব্য রাখেন সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। গোলটেবিল বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে তা দেশের বায়ু দূষণের একক বৃহত্তম উৎস হবে। তিনি বলেন, অসত্য প্রচারণা ও গায়ের জোরে সরকার রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চেষ্টা করছে। রামপালে প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সারা দেশের বায়ু দূষণকারী উৎসের মধ্যে বৃহত্তর একক উৎস হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদগীরণ সুন্দরবন ইকো সিস্টেমসহ সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের খুলনা, অশোক নগর, কল্যাণগড়, সাতক্ষীরা, বেগমগঞ্জ, বশিরহাট, নরসিংদী, নোয়াখালী, বাসীপুর ও কুমিল্লা অঞ্চলের ওপরের বাতাসে বিষাক্ত ধূলিকণার মাত্রা বাড়িয়ে দেবে।
গবেষণায় বলা হয়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে ঢাকা ও কলকাতার বাসিন্দারা, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা বায়ুদূষণে মারাত্মক আক্রান্ত হবে। লরি মাইলিভিরতার গবেষণায় বলা হয়, আগামী ৪০ বছরে এসব প্রাণহানি ও কম ওজন শিশুদের জন্ম হবে। বাংলাদেশে বায়ুদূষণ যদি নাও থাকে, তবু এসব ঘটনা ঘটবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে অতি উচ্চমাত্রায় ‘স্নায়ুবিষ’ পারদ বের হবে। যা শিশুদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পারদের দূষণের কারণে সুন্দরবনের চারপাশের ৭০ কিলোমিটার এলাকার মাছ খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়বে। কেউ যদি ওই মাছ খায় তাহলে সে স্নায়ুজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হবে। গোলটেবিল বৈঠকে সুলতানা কামাল বলেন, শুধু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, আমরা দেশের কোথাও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হোক এটা চাই না। বিশ্বজুড়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সবচেয়ে ক্ষতিকারক হিসেবে প্রমাাণিত হচ্ছে। বেশির ভাগ দেশ নতুন করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে না। সরকার ধমক-ধামক দিয়ে গায়ের জোরে রামপাল প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বাপার সাধারণ সম্পাদক ডা. আবদুল মতিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুন নাহার, ডা. আবু সায়ীদ।
রামপাল বিদ্যুৎ নির্মাণ নিয়ে পরিবেশবাদীদের এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, যারা বিরোধিতা করছেন তাদের উদ্দেশ্য হলো দেশের উন্নয়নে বাধা দেওয়া। তারা অন্য কারও এজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমেছে। পরিবেশ সুরক্ষা বা দেশের মানুষের উন্নয়ন করার পক্ষে এরা প্রতিনিয়ত বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই সরকার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন করে বিরোধীপক্ষ নেমেছেন মানুষের দুর্বল জায়গায় আঘাত করার জন্য। স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বলে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। তাদের এই বিষয় থেকে সরে আসার আহ্বান জানান প্রতিমন্ত্রী। বিপু বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এই দেশের কোনো ক্ষতি হতে দেবে না।
আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, এরা আসলে পরিবেশের বিষয়ে সোচ্চার নয়, তাদের বিরোধিতা হলো সরকারের ভালো কাজে বাধা দেওয়া। তিনি বলেন, এটা তাদের বিরোধিতার বাণিজ্য। পরিবেশ রক্ষায় এই সরকার অনেকগুলো যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে।
নদী বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ড. আইনুন নিশাত বলেন, আমার কাছে মনে হয় এই বিরোধিতায় কারিগরি দিকের চেয়ে রাজনৈতিক বিষয় বেশি যুক্ত। এই সংগঠনগুলো এখন বলছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে স্বাস্থ্যহানি ঘটবে। শুরু থেকেই তারা রামপাল নিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করছে। অথচ দেশে আরও ছয়টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে সেগুলো নিয়ে পরিবেশবাদীদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলেন, গুটিকয় পরিবেশবাদী রামপাল নিয়ে বিরোধিতা করেই যাচ্ছেন। এর আগেও তারা বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এসেছেন। সরকারও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে রামপালের ক্ষতির দিক যাচাই-বাছাই করে সেভাবে প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছে। কাজেই পরিবেশবাদীদের এ নিয়ে বেশি উৎকণ্ঠার প্রয়োজন নেই। সম্পাদনা : হুমায়ুন কবির খোকন