হার্টের রিং বাণিজ্য বন্ধ হলেও…
ডা. জাকির হোসেন
কিছুদিন আগে সরকার হার্টের স্টেন্ট (রিং) এর দাম নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির সুপারিশ মোতাবেক সরকার হার্টের স্টেন্ট দাম নির্ধারণ করে। স্টেন্ট এর দাম নির্ধারণের পর স্টেন্ট ব্যবসায়ীরা ধর্মঘটের ডাক দেয়। এতে মহাবিপদে পড়ে হার্টে স্টেন্ট বসাতে আসা শতশত রোগী। কিছু পত্রিকা এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত প্রায় ১২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকে জড়িয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন ছেপেছে। প্রতিবেদন সঠিক হলে চিকিৎসক সমাজের জন্য তা সম্মানজনক নয়। আমি সবসময় একটি কথা স্বীকার করি, চিকিৎসক সমাজ বলে নয়, কোনো একটি সোসাইটির সবাই ভাল মানুষ হয় না। সেই দিক থেকে চিকিৎসক পেশার সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগই চিকিৎসক সবসময় রোগীর ভাল চান। মিডিয়া কর্মী যারা স্বাস্থ্য বিভাগ নিয়ে কাজ করেন, তারা বেশির ভাগ নিউজ করেন সমস্যার একেবারে গভীরে না গিয়েই। হাতেগোনা কয়েকজন চিকিৎসক কিন্তু রিং ব্যবসায়ী না। তারা নিয়ন্ত্রণহীন মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা ভোগী মাত্র।
সরকার যে উদ্যোগটি নিয়েছিল তা শতভাগ সফল হতো যদি মাঠ পর্যায়ের কর্মরত চিকিৎসক, মিডিয়া কর্মী, ব্যবসায়িক প্রতিনিধি, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একজন প্রতিনিধি একসঙ্গে বসে যদি এই অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একটি সিদ্ধান্ত নিত। আমি মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসকদের কথা এই জন্য বললাম, তারা জানে এই মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীরা কিভাবে সাধারণ রোগীদের প্রতারিত করছে। কোনো একদিন এক ট্রাফিক পুলিশকে রাস্তায় রশি টানিয়ে ডিভাইডার তৈরি করতে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা মিটিংগুলোতে আপনারা এইভাবে ডিভাইডার তৈরি করতে বলেন না কেন?’ উনি উত্তরে বলেছিল, ‘যারা ওই সকল মিটিংগুলোতে উপস্থিত থাকে তারা কোনোদিন রাস্তায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে না।’ ঠিক এই সত্য বাক্যটি স্বাস্থ্য বিভাগের জন্যও প্রযোজ্য। সরকার এই উদ্যোগটি একটু পরিকল্পনা মাফিক নিতে পারলে এর শতভাগ সুফল পেত সাধারণ রোগীরা। কিন্তু বর্তমানে এই ব্যবসায়ীরা সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও এর খুব একটা সুফল সাধারণ রোগীরা পাবে বলে একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার কাছে মনে হয় না। যে সকল চিকিৎসক মাঠ পর্যায়ে রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত কেবল তারাই বুঝবে এই সকল ব্যবসায়ীরা কিভাবে সরকার এবং রোগীর সঙ্গে প্রতারণা করছে। এখন থেকে নিম্নমানের রিং উচ্চমূল্যে রোগীদের ক্রয় করতে বাধ্য করা হবে।
চিকিৎসকেরা যতই ভাল মানের স্টেন্ট এর কথা লিখে দিক না কেন, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কখনই সঠিক রিং রোগীকে সরবরাহ করবে না। আর চিকিৎসকদের হাত-পা যে বাঁধা এটাও এই সকল মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীরা খুব ভালভাবে জানে। প্রতারক চক্র জানে, একজন চিকিৎসক এই রিং খারাপ জানলেও প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়ার কোনো ক্ষমতা চিকিৎসকের নেই। তাই চিকিৎসক রিং খারাপ বিবেচনা করে ফেরত পাঠালেও প্রতারক চক্র কখনই রোগীকে চিকিৎসকের চাহিদা মাফিক স্টেন্ট দিবে না। আবার চিকিৎসক বারবার রিং ফেরত পাঠালে কিছু রোগীর স্বজনরা আরও বেশি বিরক্তিভাব প্রকাশ করেন। নন মেডিকেটেড রিংয়ের মূল্য কম। মেডিকেটেড রিংয়ের মূল্য অনেক বেশি এবং নিরাপদ। কিন্তু রোগীরা কোনোদিনই সঠিক দামে সঠিক রিং পাবে না, যতক্ষণ না ওই মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসকদের হাতকে শক্তিশালী করা হবে। তাই আপাতদৃষ্টিতে রিং বাণিজ্য বন্ধ হবে মনে হলে এ নিয়ে সাধারণ রোগীর খুব বেশি আশা করে লাভ নেই। স্বাস্থ্য বিভাগে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রত্যেকটি সমস্যার গভীরে গিয়ে উদার মন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রশাসনিক কাঠামোকে সুবিন্যস্ত করে যাদের যেখানে যতটুকু ক্ষমতার প্রয়োজন, সরকারের উচিত সে ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যবস্থা করে দেওয়া। তা না হলে অতি সম্প্রতি সরকার যাত্রীদের সুবিধা বাড়ানোর জন্য সিটিং সার্ভিস বন্ধ করতে গিয়ে যে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি করেছিল, স্বাস্থ্যখাতেও এই মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা একই রকম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখবে।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান