ক্ষুদ্র ঋণে আত্মকর্মসংস্থান : অসম্ভব সাধারণীকরণ
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
উৎপাদনের পরিমাণের মাত্রা নিয়েও আমাদের দেশে উদ্যোক্তা তৈরিতে রয়েছে সমস্যা। একজন বেকার যুবক যখন কোথাও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে উৎসাহী হয় তখন প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তাদের ক্ষুদ্র পরিসরে আরম্ভ করতে হয়। কেউ হয়তো চিন্তা করতে পারে তাতের শাড়ি নিয়ে কাজ করবে। শাড়ি বুনন বা ব্যবসা পরিচালনার উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে শাড়ির ব্যবসা শুরু করতে পারে। যেহেতু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সেহেতু তার পক্ষে বেশি শাড়ি উৎপাদন করা সম্ভব না। উৎপাদনের পরিমাণ কম হওয়ার কারণে শাড়ির এককপ্রতি উৎপাদন ব্যয় বেশি হবে। উদ্যোক্তার শাড়ির চাহিদা যদি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তখন বড় কোনো উদ্যোক্তা তাতের পরিবর্তে মেশিনে ওই শাড়ি তৈরি করবে। মেশিনে শাড়ি তৈরির কারণে এককপ্রতি উৎপাদন ব্যয় অনেক কমে আসবে। তখন ক্রেতারা প্রায় একই শাড়ি বেশি দামে কিনবে না। যদি অনুরুপ শাড়ি ভারত থেকে আসতে শুরু করে তখন অল্পসংখ্যক ক্রেতাই বলবে এটি আমার দেশে তৈরি শাড়ি এটি ক্রয় করলে একজন বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হবে। বেশির ভাগ ক্রেতা কম দামে ভারতীয় শাড়ি কিনবে। ফলে, উদ্যোক্তারা উৎপাদনের পরিমাণগত সমস্যার কারণেও বাজারে টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়।
প্রযুক্তিগত পরিবর্তনও আমাদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এক ধরনের হুমকি। যখন কোনো প্রযুক্তির পরিবর্তন হয়, উন্নত হয় তখন তা গ্রহণ করতে না পারলে একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হয় না। আমাদের দেশের খুব কম সংখ্যক উদ্যোক্তারই অতিরিক্ত অর্থ আছে যারা নতুন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতে পারে। বড় একটি অংশই প্রযুক্তির এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তারাও বাধ্য হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে। কারণ, উন্নততর প্রযুক্তি মানেই আরও স্বল্প ব্যয়ে ও কম সময়ে অধিক মানসম্পন্ন পণ্য তৈরির নিশ্চয়তা। কিন্তু আমাদের দেশের কয়জন উদ্যোক্তার পক্ষে নতুন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করা সম্ভব? এই সমস্যাটি শুধু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। একজন বড় উদ্যোক্তাও এ ধরনের সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ হতে পারে। কারণ, বড় উদ্যোক্তা হয়তো অধিক অর্থের মালিক। কিন্তু তার উৎপাদিত পণ্যকে যদি বিদেশি কোনো ব্র্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয় তাহলে সেখানেও প্রযুক্তিগত সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এদেশের ক্রেতাদের কাছে ভারতীয় সুতি শাড়ির অধিক চাহিদার এটাই অন্যতম কারণ।
বিশ্বায়নের যুগে পণ্যের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া যায় না। তাই শুধু নিজের দেশের পণ্যের সঙ্গেই প্রতিযোগিতা হবে এমনটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের প্রতিবন্ধকতার পরেও কেউ কেউ আত্মকর্মসংস্থানের পথে সফলতা দেখাতে পারে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় পরবর্তী পর্যায়ে তার ছেলে-মেয়েরা ওই অভিন্ন উদ্যোগে আর আসতে চায় না। ছেলে-মেয়েরা অল্প পড়ালেখা করলেও অন্য কোনো পেশার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে যখন উদ্যোক্তার বয়স হয়ে যায়, কাজ থেকে অবসর নেওয়ার সময় চলে আসে তখন তার উদ্যোগটিকে আর কেউ ধরে রাখে না। ছেলে-মেয়েরা চাকরি নিয়ে সৌদি আরব বা মালয়েশিয়া গিয়ে হয়তো শ্রমিকের কাজ করবে কিন্তু দেশে পিতার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানকে সামনে এগিয়ে নিবে না। এটিও আমাদের দেশে উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা।
উদ্যোক্তা তৈরির পথে এমন একটি চিত্র যেখানে দৃশ্যমান সেখানে আমাদের মনে হয় ভেবে দেখা প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল একটি প্রবৃদ্ধির জন্য এ ধরনের একটি পন্থা আদৌ খুব কার্যকর ফলাফল বয়ে আনতে পারবে কিনা। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করার জন্য আর সময় ব্যয় করার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে, বিশ্বায়নের এই সময়ে, অবাধ অর্থনীতির যুগে উদ্যোক্তা তৈরির সার্বিক বিষয়গুলো বিবেচনা না করে যারা উদ্যোক্তা হতে চায় তাদের নিয়ে আমরা আবেগ দেখাতে পারব, রাজনীতি করতে পারব কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফলাফল কি হবে। একদিকে তারা দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারবে না। আবার অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতেও তাদের কোনো অবদান থাকবে না। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে আমরা কি করব? এক্ষেত্রে এককথায় বলা যায় আমাদের দ্রুত শিল্পায়ন করতে হবে। বৃহৎ পরিসরের শিল্পায়ন করতে হবে যেখানে যেকোনো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো সক্ষমতা থাকবে। পণ্যের মান উন্নত হবে। একক প্রতি উৎপাদন ব্যয় কমে আসবে। আর এই ইস্যুতে হাজার হাজার লোককে উদ্যোক্তা বানানোর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই। শুধু যাদের মধ্যে সৃজনশীলতা আছে, প্রচ- ইচ্ছা বা আগ্রহ আছে, ঝুঁকি নেওয়ার মতো সাহস আছে এবং একজন উদ্যোক্তা হওয়ার মতো মনমানসিকতা আছে তাদের জন্যই প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে।
তবে, শুধু প্রশিক্ষণের আয়োজন করলেই একজন সফল উদ্যোক্তা পাওয়া যায় না। উদ্যোক্তাকে সফল হওয়ার জন্য যে ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা থাকা প্রয়োজন তারও ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অবকাঠামো ঠিক করার দায়িত্ব উদ্যোক্তার নয়। রাস্তা নির্মাণ, ব্রিজ নির্মাণ, খনি থেকে কয়লা উত্তোলন, বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা, গ্যাস সরবরাহ করা এবং উৎপাদন কাজে ব্যবহার হতে পারে এ ধরনের সুবিধাগুলো কোনো উদ্যোক্তার পক্ষে আয়োজন করা সম্ভব না। আমরা এ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো চিন্তা না করে উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির জন্য প্রতিবছর যে পরিমাণ সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়মের আয়োজন করি তা বাদ দিয়ে নতুনভাবে ভাবার সময় এসেছে। বরং আমাদের চিন্তা করার সময় এসেছে যারা প্রকৃতপক্ষে উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা রাখে তাদের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করা এবং ওই উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্য দক্ষ মানবশক্তি তৈরি করা। কারণ, আমাদের দেশে দক্ষ মানবসম্পদের বড় অভাব। একজন ব্যক্তির উদ্যোক্তা হওয়ার সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরেও মানবসম্পদের স্বল্পতার কারণে তার উদ্যোগটি থেমে যেতে পারে। তাকে লোকসানের মধ্যে পড়তে হতে পারে। (চলবে-৩)
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান