বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দূরত্ব কমছে না
এস এম নূর মোহাম্মদ : বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের নির্বাহী বিভাগের দূরত্ব বেড়েই চলেছে প্রতিনিয়ত। এর আগেও কয়েকবার সারা দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বিচার বিভাগের সঙ্গে টানাপোড়েনের বিষয়টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে।
বিচার বিভাগ নিয়ে সরকার এবং বিভিন্ন মহলের মন্তব্যের সূত্র ধরে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনও করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। উভয় পক্ষই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে।
বিএনপিপন্থিরা বলেন, বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা, বিধি প্রণয়নের জন্য সর্বোচ্চ আদালত থেকে অনেক নির্দেশনা দিয়েছেন। তারপরও গেজেট প্রকাশিত হয়নি। সরকার এজন্য মোট ৬৭ বার সময় নিয়েছে। আর সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চায় না বলেই সময় ক্ষেপণ করছে বলে অভিযোগ তাদের। তবে সরকারের কেউই বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় কিংবা বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় এমন কোনো বক্তব্য প্রদান করেননি বলে দাবি করেন আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা। সম্প্রতি রাজধানীর কাকরাইলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের জন্য নবনির্মিত আবাসিক ভবন ‘জাজেস টাওয়ার’ উদ্বোধনের সময় বিচার বিভাগের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরে ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থে সরকার-বিচার বিভাগে একত্রে কাজ করতে হবে। তবে কোনো সমস্যা হলে আলোচানার মাধ্যমে তা সমাধান করতে হবে বলে জানান শেখ হাসিনা।
গত ৩০ এপ্রিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন কোনো আইন করলে সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করে দিবে। সেইসঙ্গে দেশে আইনের শাসন নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। প্রধান বিচারপতির এমন বক্তব্যের পর আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, অন্য কোনো দেশের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্যে এত কথা বলেন না।
পরে অবশ্য প্রধান বিচারপতি তার অপর এক বক্তব্যে বলেন, অন্যান্য দেশে প্রধান বিচারপতিরা এত কথা বলেন না, কারণ সেসব দেশে আইনের শাসন রয়েছে। কিন্তু আমাকে বলতে হয়, আমার কথা বেশি বের হয়, কারণ এখনো দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে সব সরকার। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশাসন চায় না। তারা বিচার বিভাগকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। অবশ্য এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের কোনো দূরত্ব নেই বলে মন্তব্য করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তবে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ দিবস উপলক্ষে গত বছর এক বাণীতে প্রধান বিচারপতি অধঃস্তন আদালত নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে টানাপোড়েনের বিষয়টি স্পষ্ট করেন। ওই বাণীতে তিনি বাহাত্তরের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনঃপ্রবর্তনের দাবি জানান।
এ সরকারের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের টানাপোড়েনের অন্যতম কারণ বিচারকদের বদলি। এ নিয়ে বিচার প্রশাসনে চলছে একধরনের অস্বস্তিভাব। জানা গেছে, ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা ছিল যে, প্রতিবছর জানুয়ারি ও জুলাইয়ে বিচারকদের বদলি করা হবে। কিন্তু তা কার্যকর হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, গত বছর সরকার প্রতি কার্যদিবসে গড়ে পাঁচজন বিচারককে বদলির প্রস্তাব করে। তবে সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে কিছুটা রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় দেয়।
শৃঙ্খলা বিধির গেজেট : মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করতে ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগ সময় দেন সরকারকে। এরপর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি খসড়া শৃঙ্খলাবিধি তৈরি করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়। কিন্তু তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে না হওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট একটি কমিটি গঠন করে পৃথক শৃঙ্খলাবিধি তৈরি করে।
এরপর এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করতে বারবার সময় নেয় সরকার। কিন্তু তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় অনেকবারই ক্ষোভ প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। এমনকি আইনমন্ত্রণালয়ের দুই সচিবকে ডেকেও ক্ষোভ জানায় সুপ্রিম কোর্ট। মূলত এই গেজেট প্রকাশ করা নিয়ে গত বছরের পুরোটা সময়ই বিভিন্ন সময় ক্ষোভ ঝাড়েন সর্বোচ্চ আদালত। অনেকের মতে গেজেট প্রকাশ না করাই টানাপোড়েনের মূল কারণ।
ভাস্কর্য : সুপ্রিম কোর্টের সৌন্দর্য বৃদ্ধির অংশ হিসেবে ন্যায়বিচারের প্রতীক রূপে সুপ্রিম কোর্টের সামনে গত বছর বসানো হয় ভাস্কর্য। তবে বিষয়টি নিয়ে তীব্র আপত্তি তোলে ইসলামিক দলগুলো। এমনকি তা সরানোর দাবিতে প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া ছাড়াও নানা কর্মসূচি পালন করে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ইসলামি দল। এমনকি সরকারের অঙ্গসংগঠন ওলামালীগও ভাস্কর্য অপসারণের দাবি তোলে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগে। যদিও এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানায়নি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
আদেশ পাল্টা আদেশ জারি : বিচারকদের বিদেশ গমন, সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণসহ বেশকিছু ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ-পাল্টা আদেশ জারির ঘটনা ঘটে গত বছরের বিভিন্ন সময়। বিদেশ গমনে সব বিচারকের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি লাগবে বলে আদেশ জারির পর প্রেষণে নিযুক্ত বিচারকদের কোনো অনুমতি লাগবে না মর্মে মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ জারি করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ না নেওয়ায় বিচারকদের অভিজ্ঞতা বিনিময় সভায় অংশগ্রহণে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন বাতিল করা হয়। এরপর সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে কর্মশালার আয়োজন করার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারকদের সরকারি গাড়ি ব্যবহার ও টিএ/ডিএ বিল বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে জারি হয় পৃথক আদেশ।
দুই মন্ত্রীকে তলব : গত বছরের শুরুর দিকে আদালত অবমাননার দায়ে সরকারের দুই মন্ত্রীকে তলব ও পরবর্তীতে তাদেরকে সাজা দেয় আপিল বিভাগ। সে সময় বিষয়টি সারা দেশের আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসে। ওই সময় অনেকে দুই মন্ত্রীর সংসদ সদস্য পদ চলে যাবার কথা বললেও তাদেরকে পদত্যাগ করতে দেখা যায়নি। এমনকি তারা সংসদ অধিবেশন এবং মন্ত্রিসভার বৈঠকেও অংশ নেন নিয়মিত।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল : বর্তমান সরকারের সময় ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। এ সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিলুপ্ত করে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেওয়া হয়। পরে এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর ৯ আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। ওই রিটের ওপর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। পরে সংসদ অধিবেশন চলাকালে এর তীব্র সমালোচনা করেন সংসদ সদস্যরা। সম্পাদনা : হুমায়ুন কবির খোকন