পদ্মা সেতু কিংবা সড়ক প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি একটি আত্মসমালোচনা
রেজওয়ান তানিম
যমুনা সেতুর যেখানে পুরো কাজটি বাইরের কোম্পানিগুলো করেছে সেখানে পদ্মা সেতুর পাঁচটি বড় চুক্তির একটি অংশের কাজ আব্দুল মোনেম কোম্পানি করার যোগ্যতা অর্জন করেছে এটা স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছরে আমাদের বড় অর্জন। তবে এ অর্জন ধুলায় মিশে যেতে পারে যদি দেশি কোম্পানিগুলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার ব্যাপারে তাদের দক্ষতা প্রদর্শন না করতে পারে। আমাদের দেশে যেকোনো প্রজেক্টে খরচ বাড়ার মূল কারণ কাজ শুরুর আগের ভূমি অধিগ্রহণ। জমি অধিগ্রহণের সময় দেখা যায় যার শুধু জায়গা আছে সেও অনেক ক্ষেত্রে একটা বাড়ি তুলে বেশি ক্ষতিপূরণ দাবি করে। সমস্ত এলাকা জুড়ে এক ধরনের ক্ষতিপূরণ আদায়ের উৎসব শুরু হয়। যে ব্যক্তির পুকুর আছে সে মাটি ফেলে পুকুর ভরাট করবে ক্ষতিপূরণ নিতে। কোনো পক্ষেই এর কোনো নজরদারি নেই। সরকারি ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যোগসাজশে এ ঘটনা একের পর এক ঘটে চলেছে যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই চর্চা বেড়ে এমন পর্যায়ে গেছে যে কারণে প্রকল্পের ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধিলাভ করে। এক ধরনের মিলে-মিশে খাই জাতীয় সামাজিক দুর্নীতি যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেখেও দেখেন না। যেকোনো ধরনের উন্নয়ন প্রজেক্টের বেলায় এটা সত্য। আর পদ্মা সেতুর মতো মেগা স্ট্রাকচার নির্মাণের সক্ষমতা নেই বলে বাংলাদেশের এই ধরনের প্রজেক্টের সঙ্গে বাইরের দেশের নজরদারি ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিদের অনেক বেশি সংযোগ থাকে। তাই এগুলো নিয়ে দুঃশ্চিন্তা কম। আর তাই মেগা প্রজেক্টের সঙ্গে ফ্লাইওভার জাতীয় ছোট বা মাঝারি প্রজেক্টের হিসেব মেলানো অর্থহীন। ওই সব প্রজেক্টে দেশীয় যেসব কোম্পানি কাজ পায় তাদের এ ধরনের কাজের সে অর্থে অভিজ্ঞতা নেই, সামর্থ্য নেই এমনকি নির্ধারিত সময়ে শেষ করার ব্যাপারে আগ্রহও নেই। এমনকি অবৈধভাবে তারা কাজ পেয়ে যান বলেও অনেক কানাঘুষা শোনা যায়।
দুর্নীতি একটা বড় বিষয়, তার চেয়ে বড় বিষয় এই দেরি। যত দেরি খরচ তত বাড়বে। এখন দেরি কেন হয় সেটাই গবেষণার। ফ্লাইওভার প্রজেক্টের কাজ পাওয়া কোম্পানিগুলো দেরি করতে করতে একেকটি প্রজেক্ট প্রায় একদশক ধরে চালায়, যেখানে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির প্রাবল্যে সবকিছুর দাম বাড়া থেকে শুরু করে আরও অনেক বিষয় ঘটে ব্যয়বৃদ্ধির। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও এক্ষেত্রে বোঝা মুশকিল যেহেতু দেরির বিষয়ে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয় না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের এখানে সীমাহীন গাফিলতি। দফায় দফায় ডিজাইন বদল, প্রকল্পের এলাইনমেন্ট বদল, ইউটিলিটি সার্ভিস প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সড়ক বিভাগের সমন্বয়হীনতা, প্রকল্পের টাইমলাইন, ক্রিটিক্যাল পাথ এসব হুটহাট করে বদল করা এ রকম হাজারো কারণ আছে। দুর্নীতি কিংবা স্বচ্ছতার অভাবের অভিযোগ যদি বাদ দিয়েও চিন্তা করা হয় তবুও এইসব অদক্ষতার কারণে প্রকল্পের খরচ ১০-২০% বেড়ে যায়। এই বিষয়ে সরকার এবং বিশেষজ্ঞ, বিদেশি পরামর্শক দল সকলের আত্মসমালোচনা দরকার। মগবাজার ফ্লাইওভারের নকশা প্রণয়নকারী মার্কিন সংস্থা এটি নকশা করেছে বাম হাতে চালানোর হিসেব করে। এই অমার্জনীয় ভুলের সঙ্গে যারা যুক্ত তারা সবাই অপরাধী, এমনকি বিশেষজ্ঞরা, পরামর্শকেরাও। এত বড় ভুল কারও চোখে পড়েনি এ অবিশ্বাস্য। এখানে দুর্নীতি হয়নি এটা বিশ্বাস করা কঠিন। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারেও কিছু কিছু জায়গায় ফ্লাইওভারের উচ্চতা অনেকক্ষেত্রে নিচ থেকে বাস জাতীয় উঁচু যানবাহনের চলাচলের উপযোগী নয়। এটা কি গাফিলতি নয় যাদের নজরদারি করবার কথা তাদের? এর দায় কে নেবে? সরকার, নাকি পরামর্শক, নাকি নির্মাণ সংস্থাÑ এটাই প্রশ্ন। আমাদের সকলের আত্মসমালোচনা জরুরি। সরকারের ঘাড়ে সব দোষ ফেলে নিশ্চিন্তে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার চেয়ে প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে নিজের জায়গা থেকে। দেশের ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ব্যবসায়ীরা যদি নিয়ম মেনে যথাসময়ে সক্ষমতার সঙ্গে কাজ শেষ করেন তবে দেশীয় কোম্পানিগুলো দেশে ও দেশের বাইরেও এ জাতীয় বড় প্রজেক্টে কাজ করতে পারবেন। কিন্তু তারা যদি বাঁকা পথে নিয়মের ব্যত্যয় বা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বেশি মুনাফার পথে আগান তবে এই খাতে দেশের উন্নতি ও এগিয়ে যাবার পথে পতন সুনিশ্চিত। (শেষ)
লেখক: প্রকৌশলী ও ভূতত্ত্ব গবেষক/সম্পাদনা: আশিক রহমান