ক্ষুদ্র ঋণে আত্মকর্মসংস্থান : অসম্ভব সাধারণীকরণ
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
আমরা সরকারি পর্যায়ে সৌদি আরবে লোক পাঠানোর চেষ্টা করছি। মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর চেষ্টা করছি। অথচ আমাদের দেশে কয়েক লাখ বিদেশি লোক কাজ করছে। তারা অধিকাংশই শ্রীলংকা ও ভারতের। এর পাশাপাশি ইউরোপের কিছু দেশের নাগরিকও আছে। এশিয়ার মধ্যে চীন, কোরিয়া তো আছেই। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করা প্রয়োজন। এখন আমাদের দেশের অনেক বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সেকেন্ড জেনারেশন লিড দিচ্ছে। প্রাণ, মেঘনা, বসুন্ধরা, স্কয়ার, ভাইয়া গ্রুপ, পারটেক্স এগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই প্রতিষ্ঠানগুলো যখন যাত্রা করেছিল তখন এগুলোর অবয়ব এ রকম ছিল না। উদ্যোগগুলোও ছিল সীমিত পরিসরে। তখন নেতৃত্বে ছিল ফার্স্ট জেনারেশন। কিন্তু তাদেরই সেকেন্ড জেনারেশন বিদেশে পড়ালেখা করে এখন ব্যবসার হাল ধরেছে। তারা আধুনিক চিন্তা-চেতনা নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করনে। তারা অনেক বড় বড় প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু, তারা প্রতিনিয়ত দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে ভুগছে। বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হচ্ছে বিদেশি দক্ষ ও চৌকষ কর্মীদের উপর।
আমরা যদি আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যায় সেখানে নিচের পদগুলোতে সব আমাদের লোক। কিন্তু মিড লেভেল থেকে শুরু করে টপ লেভেল পর্যন্ত অনেক বিদেশি কর্মী কাজ করছে। কারণ, বিদেশি বায়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য যে ধরনের যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রয়োজন তা আমাদের দেশের লোকদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। আগে মনে করা হতো ইংরেজি জানলেই বিদেশি বায়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তৈরি পোশাকের অর্ডার পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক বাজারে শুধু ভাষাজ্ঞান দিয়ে তা আর আজ হচ্ছে না। তাছাড়া আমাদের দেশে ইংরেজিতে ভালোভাবে কথা বলতে পারে ও লিখতে পারে এমন লোকের সংখ্যা খুব বেশি না। একজন মার্চেন্ডাইজারকে বিজনেস অ্যানালাইসিসও ভালোভাবে জানতে হয়। আবার এমন অনেক বিদেশি বায়ার আছে যারা ইংরেজি ভালো জানে না। তারা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করে। কেউ স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। আবার কেউ ফ্রেঞ্চ ভাষায়। চীনারা তো ওদের ভাষা ছাড়া কিছু বুঝেই না। ফলে একজন দক্ষ মার্চেন্ডাইজার হতে হলে তাকে কয়েকটি ভাষায় পারদর্শী হতে হয়। আর সঙ্গে প্রয়োজন ব্যবসায়িক জ্ঞান। বাস্তবে দেখা যায় বিদেশি যারাই এদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে কাজ করছে তারা আমাদের লোকদের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ। এখন প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের নিয়োগ দিতে হচ্ছে। তারা এদেশের যেকোনো কর্মীর তুলনায় অনেক বেশি বেতন নিয়ে যাচ্ছে। অথচ এদেশে লাখ লাখ বেকার চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমরা দ্রুত শিল্পায়নের কথা বলছি। আমাদের এই মুহূর্তে একটি বড় সুবিধা হলো ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার শতকরা হারে যুবকের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। এটি যেকোনো দেশের জন্য একটি বড় সুবিধা। কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো এই তরুণ বা যুবকরা কর্মক্ষম না। ফলে এদের প্রশিক্ষিত না করে কোথাও নিয়োগ দেওয়া হলে ওই প্রতিষ্ঠানকেই ঝামেলায় পড়তে হবে। এ অবস্থা আমাদের দেশের ভেতরের। কিন্তু দেশের বাইরের চাকরির বাজারের কি অবস্থা। সেখানেও একই দৃশ্য বিদ্যমান। যারাই বিদেশে যাচ্ছে তাদের সিংহভাগই কোনো প্রশিক্ষণ না নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। ফলে বিদেশে এদের কাজের ক্ষেত্রগুলো একদম নিচের স্তরে। অথচ ভারত, শ্রীলংকা, ফিলিপাইন থেকে যারাই ওই দেশগুলোতে যাচ্ছে তারা কোনো না কোনো কাজে দক্ষতা অর্জন করে যাচ্ছে। কম্পিউটার, হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার বা অন্য যেকোনো কাজে দক্ষতা অর্জন করে তারপর যাচ্ছে। ফলে আমাদের দেশের একজন কর্মী যা আয় করছে ওই সকল দেশের নাগরিকরা তারচয়ে কমপক্ষে একশ গুন বেশি টাকা আয় করছে। (চলবে-০৪)
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান