হাওরের বাস্তবতা এবং সমাজ-সরকার-মানবতা
মঞ্জুরুল আলম পান্না
২৭ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকে হাওরের মানুষের জন্য ত্রাণের কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘দেশে খাদ্য ঘাটতি নেই। মানুষকে যত প্রয়োজন খাদ্য দেওয়া হবে। পুনর্বাসনে নেওয়া হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। যতদিন পর্যন্ত এ অবস্থার উন্নতি না হবে, ততদিন সরকারের ত্রাণ কার্যক্রম চলবে’ (ইত্তেফাক, ২৭-০৪-২০১৭)।
প্রধানমন্ত্রী হয়তো তার আন্তরিকতা থেকেই উপরের কথাগুলো বলেছেন। বাস্তবে এর প্রতিফলন ততটা নেই। হাওর এলাকায় মানুষের অভাব এখন প্রকট। ত্রাণ সরবরাহের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। গত বুধবার সামান্য কিছু ত্রাণের ব্যবস্থা করে আমরা কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী গিয়েছিলাম নেত্রকোনার বিপর্যস্ত হাওরাঞ্চলে। দেখেছি খাবারের জন্য বুভুক্ষ মানুষের আহাজারী। সেখানকার খালিয়াজুরী উপজেলার আসাদপুর গ্রামের একটি শিবিরে ১২৮ পরিবারের মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র একবার ত্রাণ পেয়েছে মাত্র ৬৭টি পরিবার। এই দুর্যোগের মধ্যেও চলছে ভোটের রাজনীতির হিসাব। হিসাব করা হচ্ছে, কে আওয়ামী লীগ আর কে বিএনপি। সরকারি দলের সমর্থক হলেই যে ত্রাণ মিলছে, সবক্ষেত্রে সেটাও সঠিক নয়। এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে দুর্নীতির। স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদেরকে একশ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা করে ঘুষ দিয়ে ত্রাণের তালিকায় নাম ওঠাতে হচ্ছে দুর্গত মানুষকে (যায়যায় দিন, ৩০-০৪-২০১৭)। প্রশাসন আর সরকার দলীয় স্থানীয় নেতাদের দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে সর্বস্বান্ত হয়েছেন যে লাখ লাখ কৃষক, বেঁচে থাকার জন্য বরাদ্দকৃত ন্যূনতম অন্ন থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন সেই দুর্নীতির কারণে।
নেত্রকোনা আসনের এমপি রেবেকা মোমেন নিজেই বলেছেন, তার এলাকায় ওএমএসের চালের ডিলারশিপ নিতে তার কাছে শুরু হয়েছে তদবির প্রতিযোগিতা। আর এভাবে তদবিরে ডিলারশিপ নিলে যে চুরি হবে তাও মন্তব্য করেছেন তিনি। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবারকে ঘোষিত ১০০ দিনের জন্য প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল এবং ৫০০ করে টাকা কতখানি প্রয়োজন মেটাবে তাদের? চলতি বছরের বাকি ২৬৫ দিন কী খাবেন তারা? ওএমএস আর ন্যায্যমূল্যের চাল কিনতে সূর্য ওঠার আগে দূর দূরান্ত থেকে আসা বুভুক্ষ মানুষগুলোর দীর্ঘ লাইন বলে দেয় কতখানি সঙ্কটে রয়েছেন দুর্গত মানুষগুলো। তিন লাখ কৃষকের জন্য ভিজিএফ কার্ড প্রদানের ঘোষণাতেও স্বস্তি প্রকাশের কিছু থাকে না। বিভিন্ন সময় ভিজিএফ কার্ড বিতরণে দুর্নীতির ঘটনাও সবার জানা। ক্ষতিগ্রস্ত ২৫ লাখ কৃষকের যে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন সূত্রে সেখানে তিন লাখ ভিজিএফ কার্ড দিয়ে কী হবে?
প্রবল বন্যা বা ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের দুর্দশার চিত্রগুলো দৃশ্যমান হয়ে হলেও ফসলহারা নিঃস্ব মানুষগুলোর কষ্ট তেমনটা দৃশ্যমান নয়। বন্যায় ঘর-বাড়ি তলিয়ে গেছে, বেঁচে থাকতে মানুষ বাঁধের ওপর গাছের সঙ্গে মাচা বেঁধে থাকছেন, এমন দৃশ্য গণমাধ্যমে দেখে আমাদের কষ্ট হয়। গবাদি পশু মরে পানিতে ভেসে যাচ্ছে এমন ছবি দেখে হৃদয়ে নাড়া লাগে, ঘূর্ণিঝড়ে ঘর-বাড়ি উড়িয়ে নিয়ে গেছে কিংবা ভেঙে পরে ধ্বংসস্তূপ হয়ে আছে, তা দেখে আমাদের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
কিন্তু এই যে শতশত কোটি টাকা দুর্নীতির কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাঁধ সংস্কার এবং নির্মাণ করতে না পারায় অকাল বন্যায় হাওরাঞ্চলে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটলো, মানুষের মনে কোনো দাগ কাঁটছে না। মানুষ আসলে বুঝতেই পারছে না তাদের কষ্টটা আসলে কেমন। পেটের যন্ত্রণার ছবি তো আর ক্যামেরাবন্দি করা যায় না! সেখানকার মানুষের ঘর-বাড়ি সব ঠিকঠাক আছে, গায়ে জামা-কাপড় আছে, রান্না করার হাড়ি পাতিল আর শুকনো চুলাও আছে, নেই শুধু সেই চুলায় রান্নার মতো চালটুকু। মানুষের অনুভূতিগুলো কেমন যেন ভোতা হয়ে গেছে অথবা সহ্যশক্তি বেড়ে গেছে কয়েকগুন। আগে যেমন যেকোনো দুর্যোগে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সচেতন মানুষেরা উদ্যোগী হতেন বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে, এখন আর তেমনটা দেখা যায় না।
হাওরের মানুষগুলোর সামনে এখন সমুহ বিপদ। এক ফসলী জমি হওয়ায় সবহারা মানুষগুলোকে উঠে দাঁড়াতে ন্যূনতম এক বছর সময় লাগবে। এই এক বছর তারা খাবেন কী? এই খাওয়ার চিন্তাতেই বেপরোয়া হয়ে নেত্রকোনার খালিয়াজুরীর আসাদ শিবিরের ২৫ বছরের যুবক কৃষক বিক্কু মিয়া বানের পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধান ডুব দিয়ে কাঁটতে গিয়ে মৃত্যুকেই আপন করে নিলেন। দুর্নীতির কোনো সুযোগ না রেখে সরকারকে তাই ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে হবে শক্তভাবে, প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তা করা যেতে পারে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি অদৃশ্য এই কষ্ট হৃদয়ের গভীর থেকে অনুধাবন করে সমাজের প্রতিশ্রুতিশীল এবং বিত্তশালীদেরও এগিয়ে আসতে হবে দুর্গত মানুষের পাশে। ‘হাওরেরর একটা মানুষ্য খাদ্যাভাবে কষ্ট পাবে না’, সরকারের এমন প্রতিশ্রুতিতে পরিপূর্ণ আস্থা আমাদের অনেক কারণেই নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা: আশিক রহমান