পাঠ্যপুস্তুকভিত্তিক মূল্যায়নে মেধা যাচাই হয় না
রাশেদা কে. চৌধুরী
এ বছর যে সমস্ত পরীক্ষার্থী কষ্ট পড়ালেখা করে পাস করেছে এবং ভালো রেজাল্ট করেছে সবাইকে অভিন্দন। অনেকেই বলছেন, এ বছর এসএসসির ফল বিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু আমি এটাকে মোটেই বিপর্যয় মনে করছি না। যে উদ্যোগটা নেওয়া হচ্ছে শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে এবং এটা আমরা অনেকদিন থেকে বলে আসছিলাম যে, পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার হওয়া দরকার। এখন পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের বড় দুটো জায়গাÑ একটা হচ্ছে পরীক্ষা নেওয়ার পদ্ধতিটাকে যুগ উপযোগী করা। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা। আরেকটা বড় জায়গা হচ্ছে, উত্তরপত্র মূল্যায়ন। উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমালোচনা ছিল। বলা হতো যে, না দেখে নম্বর দেওয়া হয়, পরীক্ষকরা ইচ্ছামতো নম্বর দেন ইত্যাদি। এ অভিযোগগুলো ছিল। এই সমালোচনার উত্তর দেওয়ার জন্য আলাপ-আলোচনা চলছিল, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল। বাংলাদেশ এক্সাম ডেভেলপ ইউনিট, যেটা ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের আন্ডারে, তারা বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করেছেন। তারা মাঠ পর্যায়ে একটা প্রশ্নপত্র দশজন পরীক্ষকের হাতে দিয়ে দশ রকম উত্তর পেয়েছেন। মানে দশে দুই নম্বরও পেয়েছে, আবার আট নম্বরও পেয়েছে। সেই জায়গায় এটাকে একটা বৈজ্ঞানিক নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেওয়ার জন্য উত্তরপত্র মূল্যায়নের পদ্ধতিটা বদলানো হয়েছে।
আমরা তো অনেক বছর ধরেই আশঙ্কা করছিলাম যে, ঢালাওভাবে নম্বর দেওয়া হয়। এবং ভালোভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয় না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা গেল আসলে ত্রুটি আছে। সেই ত্রুটিটা সারানোর প্রথম প্রয়াসের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখি। এখন এ নিয়ে অভিভাবক বা শিক্ষার্থীদের এত মন খারাপেরও কিছু নেই। উল্লোসিত হওয়ারও কিছু নেই। পৃথিবীর সর্বত্রই পরীক্ষা পদ্ধতি যুগোপযোগী করার জন্য কিছুদিন পরপর সংস্কার করতে হয়। পাঠ্যক্রমে সংস্কার করতে হয়। শিক্ষাক্রম বা কারিকুলামে সংস্কার করতে হয়। এগুলো চলমান পদ্ধতি। তারই ফলোশ্রুতিতে ই সংস্কার এসেছে। আমি মন্ত্রণালয়কেই ধন্যবাদ দেব উদ্যোগা তারা নিয়েছেন। পরবর্তীতে অবশ্যই আরও বৈজ্ঞানিক করা হবে।
এসএসসিতে এবার পাসের হার কমেছে। এখানে কোনো কোনো বোর্ড খুবই খারাপ ফল করেছে। মানে অন্যান্যদের তুলনায় অনেক খারাপ করেছে। যেমন কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড। কুমিল্লা বোর্ডের ফল খারাপের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, কুমিল্লা শহরের চেয়ে শহরের স্কুলগুলো বেশি খারাপ ফল করেছে। এতে গড় কমে গেছে। এই বোর্ডের ফল খারাপে আরেকটি গুরুতর কারণ হচ্ছেÑ ইংরেজি আর গণিতে শিক্ষার্থীরা খারাপ ফল করেছে। খোঁজ নিয়ে দেখুন, কুমিল্লা বোর্ডের কতগুলো মাধ্যমিক স্কুলে গণিত ও ইংরেজিতে কতজন দক্ষ প্রশিক্ষিত শিক্ষক আছেন? এটা তো প্রাথমিক সমাপনী নয় যে, ইসলাম শিক্ষার শিক্ষকও বাংলা পড়াতে পারেন। এটা তো এসএসসি পরীক্ষা। এখানে তো দক্ষ প্রশিক্ষিত বিষয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষক থাকতে হবে। আমরা কিছুদিন আগে দেখেছি রাজশাহী মহানগরের একটা বড় সরকারি স্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষক নেই। দক্ষ, প্রশিক্ষিত বিজ্ঞানের শিক্ষক, ইংরেজির শিক্ষক, গণিতের শিক্ষক কোথায়? এগুলো এখন সামনে আসা দরকার। আমাদের বাচ্চারা কেন খারাপ করবে? খারাপ করছে কেন? নিশ্চয় এটার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে। শুধু উত্তরপত্র মূল্যায়নের বিষয় নয়। এই ফল খারাপের বিষয়ে আরও গভীরে যেতে হবে।
পরীক্ষা হলো একটা পদ্ধতি। মেধা বা মান যাচাইয়ের আরও অনেক পদ্ধতি রয়েছে। নিয়মিত শ্রেণিকক্ষভিত্তিক মূল্যায়ন দরকার। শুধু পাঠ্যপুস্তুকভিত্তিক মূল্যায়নে মেধা যাচাই হয় না। হয় না বলেই মন্ত্রণালয় একটা মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। মন্ত্রণালয় প্রতিবছর মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। দেখা হয়, বাচ্চারা কি শুধুই পাঠ্যবইয়ের মধ্য দিয়েই পরীক্ষা দিয়ে শিখছে, নাকি বাইরে থেকেও জ্ঞান আহরণের করার মধ্য দিয়েও শিখছে। কাজেই পরীক্ষা হচ্ছে, মেধা যাচাইয়ের একটা মাত্র উপাদান। মেধা যাচাইয়ের আরও অনেক উপাদান রয়েছে। সেগুলো করা হয় কিনা সেটাও দেখা দরকার। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন। মেধা যাচাইয়ের একটা প্রক্রিয়া হচ্ছে পরীক্ষা।
পরিচিতি: শিক্ষাবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
মতামত গ্রহণ: তানভীন ফাহাদ
সম্পাদনা: আশিক রহমান