থ্যালাসেমিয়া : চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
ডা. এ কে এম একরামুল হোসেন স্বপন
থ্যালাসেমিয়া শব্দটি অনেকটা নিরীহ মনে হলেও যেসব পরিবারের সন্তানেরা এ রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাদের জন্য এর পরিণতি হয় ভয়াবহ। খুব সহজ ভাষায় বলা যায় এটি রক্ত সম্পর্কিত এবং বংশগত এক রোগ। মাতা-পিতা দুজনেই যদি এ রোগের বাহক হয়ে থাকেন তাহলে কেবলমাত্র তাদের সন্তানেরা এ রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। তবে মাতা বা পিতার মধ্যে শুধু একজনই যদি এ রোগের বাহক হন তাহলে তাদের সন্তানেরা শুধু রোগটির বাহক হয়ে জন্মাতে পারে, রোগাক্রান্ত হয়ে নয়। মায়ের গর্ভধারণের একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই এ রোগের উপস্থিতি শুরু হয় যা ভ্রুণের অত্যন্ত সুক্ষ্ম একটি পরীক্ষার মাধ্যমেই নির্ধারণ করা যায় যে সন্তানটি কি সুস্থ হয়ে জন্মাবে নাকি রোগাক্রান্ত বা শুধু ধারক-বাহক হয়ে জন্মাবে। নতুবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণত থ্যালাসেমিয়া রোগটি ধরা পড়ে সন্তানটি জন্মানোর এক বা দুবছর পর যখন উপসর্গ হিসেবে প্রচ- রক্তশূন্যতা দেখা দেবে।
রোগের কারণ: আমাদের শরীরে যে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তা প্লাজমা, লোহিত রক্তকনিকা, শ্বেত কনিকা, প্লেটিলেট ইত্যাদি উপাদানের মাধ্যমে গঠিত। লোহিত রক্তকনিকার মধ্যে হিমোগ্লোবিন থাকে বলেই রক্তের রং লাল হয়। এই হিমোগ্লোবিনই আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নিয়মিত অক্সিজেন এবং খাদ্য উপাদান বহন করে বলেই আমরা সুস্থ ও সবল হয়ে বেঁচে থাকি। লোহিত রক্তকনিকার জীবনকাল সাধারণত ১২০ দিন। মৃত কনিকাগুলোর স্থান পূরণের জন্য আমাদের দেহ অনবরত লোহিত কনিকা উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া রোগীর লোহিত কনিকা ১২০ দিন পর্যন্ত বেঁচে নাও থাকতে পারে অথবা লোহিত কনিকার মধ্যেস্থিত হিমোগ্লোবিন ত্রুটিযুক্ত হওয়ায় রোগীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নিয়মিত অক্সিজেন সরবরাহ নাও করতে পারে। ফলে রোগী রক্তশূন্য হয়ে পড়ে। দুঃখের বিষয় এই রোগ থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার সহজ ও কার্যকর কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। বর্তমানে যে চিকিৎসা পদ্ধতি বিদ্যমান তা গ্রহণ না করলে এই রোগীরা মাত্র ৫ থেকে ৬ বছর বেঁচে থাকে।
চিকিৎসা পদ্ধতি ও জটিলতা: অত্যন্ত প্রাথমিক অবস্থায় যথোপযুক্ত রোগ নির্ণয়, নিয়মিত নিরাপদ রক্ত গ্রহণ এবং কিছু নির্দিষ্ট ঔষধ গ্রহণের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগীরা সাধারণভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। অধুনা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীর বিভিন্ন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতামতের ভিত্তিতে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি বিধিমালা প্রণয়ন করেছে যা ‘প্রটোকল অব ট্রিটমেন্ট ফর থ্যালাসেমিয়া পেসেন্টস’ নামে প্রচলিত। অত্যন্ত সুখের বিষয় যে, পৃথিবীব্যাপী যে প্রচুর জনগোষ্ঠী এ রোগ নিয়ে ভুগছেন তাদের অনেকেই প্রণীত এ বিধিমালা যথাযথ অনুসরণ করে প্রায় স্বাভাবিক মানুষের মতোই জীবনযাপন করছেন, লেখাপড়া করছেন, জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজ করছেন এবং মা-বাবাও হচ্ছেন। অথচ দুঃখের বিষয় যে এ চিকিৎসা পদ্ধতি এতই ব্যয়বহুল যা বেশিরভাগ বাংলাদেশি রোগীর জন্য জোগাড় করা সাধ্যেরও অতীত। বাংলাদেশে এই খরচ মাসে ৭ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। কারণ নিয়মিত নিরাপদ রক্ত গ্রহণ থ্যালাসেমিয়া রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা হলেও এটা হলো চিকিৎসার সর্বনিম্ন খরচের অংশ। সবচাইতে বড় খরচের অংশ হলো ঔষধ গ্রহণ। থ্যালাসেমিয়া রোগীর শরীরে অতিরিক্ত লৌহ জমার প্রধান কারণ হলো নিয়মিত রক্ত গ্রহণ। প্রতিবার রক্ত গ্রহণের সঙ্গে এই লৌহের পরিমাণ উত্তোরত্তর বেড়ে যায়। এই লৌহ ক্রমান্বয়ে জমা হতে থাকে রোগীর বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে যেমন যকৃত, অগ্নাশয়, হ্নদযন্ত্রে। ফলে রোগী ধীরে ধীরে জন্ডিস, বহুমূত্র প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হয় এবং সর্বশেষ হ্নদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এছাড়াও এই অতিরিক্ত লৌহ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হরমোন তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিও বাধাগ্রস্থ করে। কাজেই থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়মিতভাবে লৌহ অপসারণকারী ঔষধ সেবন করা অত্যাবশ্যকীয়।
প্রতিরোধের উপায়: বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী দেখা যায় বাংলাদেশের শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগ মানুষই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। এদেশে দুই বাহকের বিয়ে বিরল ঘটনা নয় এবং এর ফলে রোগীর সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। প্রতিবছর প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে এ রোগ নিয়ে যাদের একটা সামান্য অংশই পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের রোগ নির্ণয় করছে এবং নিয়মিত ঔষধ গ্রহণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। কিন্তু অধিকাংশ অকালে মৃত্যুবরণ করছে শুধুমাত্র যথাসময় রোগ নির্নয় না হওয়ার কারণে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, খুব সহজেই কিন্তু এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। ব্যাপক জনসচেতনতার মাধ্যমে বিয়ের পূর্বে রক্তের একটি পরীক্ষার মাধ্যমে বাহক নির্ণয় করে বাহকে বাহকে বিয়ে নিরুৎসাহিত বা বন্ধ করার মধ্য দিয়েই কেবলমাত্র এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। সাইপ্রাস, ইতালি, গ্রিস যার প্রকৃত উদাহরণ। বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া হাসপাতাল মাত্র ৫০০/- (পাঁচশত) টাকার বিনিময়ে এ রোগের বাহক নির্ণয়ে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাচ্ছে।
লেখক: সিওও এবং কনস্যালটেন্ট (প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট), বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি ও হাসপাতাল
সম্পাদনা: আশিক রহমান