দিবস পালিত হয় কিন্তু শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় কী?
ডা. জাকির হোসেন
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যা বিশ্বব্যাপী মে দিবস নামে অভিহিত। প্রতিবছর ১ মে বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়। এই দিন আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের উদযাপন দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। বিশ্বের প্রায় ৮০টির বেশি দেশে ১ মে জাতীয় ছুটির দিন এবং সরকারিভাবে এটি পালন করা হয়। বিশ্বের আরও অনেক দেশে এই দিবসকে বেসরকারিভাবে পালন করা হয়। মে দিবসের সম্পর্কে ইতিহাসের পাতা থেকে যতটুকু জানা যায় তা হলোÑ ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে রাখতে মে দিবস পালিত হয়। সেদিন ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন আট ঘণ্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়ে তাদের দাবি নিয়ে যখন মিছিল শুরু হয় তখন ওই মিছিলকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ওই সংঘর্ষের ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালে তার এই প্রস্তাব আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত হয়। সেই থেকে মে দিবস আজও পালন হযে আসছে।
সে সময় শ্রমিকের জন্য কাজের নির্দিষ্ট সময় যেমন বাঁধা ছিল না, তেমনি ছিল না মজুরির কোনো নিয়ম-কানুন। একপ্রকার দাসের মতো শ্রমকে ব্যবহার করা হতো। ফলে শ্রমিকের শ্রমকে মালিকরা তাদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে মালিক অর্জন করতেন সীমাহীন সম্পদ। বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করে বাংলাদেশেও মে দিবস পালন হয়ে আসছে। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও মে দিবসের মূল প্রতিপাদ্যকে যেন বাংলাদেশ তার হৃদয়ে ধারণ করতে পারেনি। বাংলাদেশে শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিনই বাড়ছে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা। গার্মেন্টস শিল্প প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এই দেশে পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকের সংখ্যাও বহুগুনে বেড়েছে। একই সঙ্গে বিদেশে কর্মরত শ্রমজীবী বাংলাদেশিরা তাদের ঘাম ঝরানো অর্থ দেশে পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য দেশি ও প্রবাসী শ্রমজীবী ভাই-বোনেরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বেশিরভাগ সেক্টরেই নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনো বহু কলকারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শ্রমজীবী মানুষগুলো কোনো রকম ঝুঁকি প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়াই তাদের ঘাম ঝরা শ্রম দিয়ে যাচ্ছে।
শ্রমজীবী মানুষগুলোর চিকিৎসাসেবা মালিকদের দেওয়ার কথা থাকলেও আজও পর্যন্ত সব কলকারখানায় চিকিৎসক নিয়েজিত করা কিংবা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। এ ধরনের বৈষম্য শুধু বেসরকারি খাতে নয়, সরকারি খাতে আরও বেশি প্রকট। বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কিন্তু সরকারি কিছু সেক্টরে কর্মচারীরা তাদের ধরা-বাঁধা অফিস সময় পর্যন্ত চাকরি করে যে বেতন পান তা আবার সরকারের যে সকল সেবাখাতে কর্মচারীরা রাত-দিন জনগণের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের সমান। এ ধরনের বৈষম্যের সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন স্বাস্থ্যখাতে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকেরা। মহিলা চিকিৎসকেরাও এখানে মাতৃত্বকালীন অধিকার থেকে একেবারেই বঞ্চিত। সরকারি অন্যান্য পেশাজীবী যেমন কৃষি, ফায়ার সার্ভিস, আরবান এলাকা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত কর্মচারীরাও শ্রম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। সরকারিভাবে শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন হলেই সারাদেশে শ্রমের একটি ইউনিক মূল্যায়ন হবে। নতুবা আজীবন মে দিবস পালন হবে কিন্তু এতে এর তাৎপর্য ঘাম ঝরা শ্রমে থাকবে না।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান