ভালো আছেন কি দেশের মানুষ?
মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম
বাংলাদেশের জনসমাজ এবং এর ভাষা-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর পালাক্রমিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে দরবার তথা শাসনকেন্দ্রের বাইরে অবহেলায়-অপাঙ্কতেয়ভাবে। প্রাচীনকালে আর্য-ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন, মধ্যযুগে তুর্কি-মোগল শাসন এবং আধুনিককালে ইউরোপীয় ব্রিটিশ ও সবশেষে পশ্চিম পাকিস্তানি নির্মম শাসন-শোষণ ও নির্যাতন মোকাবিলা করে বাঙালি জাতি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকের একুশ দফা, ষাটের দশকের ৬ দফা এবং ১১ দফাভিত্তিক আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি তার আজীবন আরাধ্য রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রশাসন ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেয়। বাঙালির জাতিগঠন ও স্বাধীনতাযুদ্ধের পেছনে রয়েছে জাতির হাজার বছরের সংগ্রাম-সাধনা এবং অসীম ত্যাগ ও আত্মবিসর্জন।
স্বাধীনতা লাভের ছেচল্লিশ বছর পার করে আজকে যদি প্রশ্ন আসে স্বাধীন দেশে মানুষ কেমন আছে? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় জীবন-জীবিকার প্রশ্নে মানুষ এগিয়েছে। কিন্তু স্বাধীন দেশে মানুষ কি ভালো আছে? কেমন ভালো আছে? সত্য স্বীকারের স্বার্থে বলতে হবে মানুষ ভালো নেই। গায়ে-গতরে, পোশাকে-আশাকে, চলা-ফেরায় দেশ আগের মতো দারিদ্র্যক্লিষ্ট অবস্থায় নেই। কিন্তু তারপরও মানুষের জীবন ভালো নেই। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ভালো চলছে না। মানুষের জীবন বিকাশের ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় এসব প্রতিষ্ঠান ভেতর থেকে মরে যাচ্ছে। মানুষের ভেতর শুকিয়ে খাক। মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছে, পশুত্ব আজ সবকিছুকে গ্রাস করতে উদ্যত। জাতি আত্মকলহে মত্ত। জাতির সামনে কোনো আদর্শ নেই, নেই গন্তব্যের কোনো লক্ষ্য ও কর্মসূচি। আজ ব্যক্তির কণ্ঠরুদ্ধ, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেও জনগণ ভীত-সন্ত্রস্ত। সমাজ-রাষ্ট্র পরিচালনার মূলশক্তি রাজনীতি। সেই রাজনীতিকে আজ সম্পূর্ণরূপে মেরে ফেলা হয়েছে। পুরো দুনিয়াজুড়েই চলছে এরূপ দুর্দশা। মানবজাতি আজ গভীর সভ্যতার সংকটে নিপতিত। এখান থেকে উদ্ধারের লক্ষ্যে কোথাও কোনো শুভ উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না।
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাÑ জাতীয় মূলনীতির এই লক্ষ্যসমূহ মুক্তিযুদ্ধের ফসল। আমাদের সংবিধানে এই চারটি মূলনীতি স্থান পেয়েছিল। কিন্তু ছেচল্লিশ বছরের ব্যবধানে এসব আদর্শ আজ জনগণের কাছে একেবারেই মূল্যহীন। এর কোনোটির প্রতি জনগণের কোনো আকর্ষণ নেই। গণতন্ত্র আজ প্রধান রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে নির্বাসিত। ফলে সমাজ-পরিবার ও ব্যক্তি জীবনের সর্বত্র আদর্শহীনতায় ছেয়ে গেছে। জনজীবনে হতাশার শিকড় গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। সমাজতন্ত্র খোদ সংবিধান থেকেই বিতাড়িত। যারা এখনো মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন তাদের ভূমিকা আজ অন্তহীন প্রশ্নের মুখে। একাত্তরের যুদ্ধকালীন সেই ইস্পাতকঠিন জাতীয় ঐক্য অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী চেতনা আজ অবিশ্বাসের অন্ধ গলিতে নিপতিত। জাতি আজ দ্বিধান্বিত-বিভক্ত। ধর্মনিরপেক্ষতা আস্তিকতা আর নাস্তিকতার ধুম্রজালে পড়ে অসার বুলিতে পরিণত। ফলে জাতি আজ এক লক্ষ্যহীন যাত্রার অভিযাত্রী।
এখান খেকে জাতিকে উদ্ধার করতে হলে রাজনীতির নামে যেসব কর্মকা- কি সরকারÑ কি বিরোধীপক্ষ থেকে চালানো হচ্ছে সেসবের অবসান দরকার। বিদ্যমান ধারার রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নবায়িত করে গণধারা অবলম্বন করে সঠিক রাজনীতি নিয়ে মানুষকে নব-উদ্দীপনায় জাগিয়ে তুলতে পারবে না।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এমনকি বামধারাসহ ডানপন্থার অন্যান্য দল বা জোট কোনোটিই জাতীয় জীবনের চলমান এই গভীর সংকটকে অনুধাবন করে না। তারা ব্যস্ত কেবল দলীয় বা গোষ্ঠীগত কায়েমিস্বার্থ হাসিলে। ১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকেই দেশি-বিদেশি কতিপয় শক্তি বাংলাদেশে নিঃরাজনীতিকরণের কার্যক্রম চালায়। তাতে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো ভেতর থেকে রাজনীতি শূন্য হয়ে নোংরা দলাদলিতে মত্ত। সরকার জাতিগঠন, রাষ্ট্রগঠন ও সর্বজনীন কল্যাণের নীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে নগ্ন ভোগবাদের পতাকা হাতে কেবল ধণিক-বণিকদের স্বার্থে কাজ করছে। জনজীবন যে সংকটে নিপতিত তা থেকে উদ্ধারলাভের জন্য দরকার নতুন রাজনীতি। সুতরাং যেখানে যুগের চাহিদার তাগিদে রাজনীতিকে নতুনভাবে সাজানো দরকার, রাজনীতিকে আরও গভীর আদর্শবাদী-মানবতাবাদী-নয়াগণতান্ত্রিক ধারায় পুনর্গঠন করা দরকার সেখানে এইসব রাজনৈতিক দল পুরাতন গতানুগতিক ধারায় ক্রমশ গণবিচ্ছিন্নের ভাগ্যবরণ করছে। গত ছেচল্লিশ বছর ধরে ব্যর্থ হতে হতে তারা দেশ ও জাতির ক্ষতিসাধনই করছে এবং আজকে এই অবস্থায় পৌঁছেছে। কাজেই তাদের দিকে তাকিয়ে থাকা ব্যর্থ সময় নষ্ট করা এবং দেশের আরও ক্ষতি ডেকে আনা ছাড়া কিছুই নয়।
লেখক: আহ্বায়ক, জাগরণী শান্তিসংঘ ও সাবেক সংসদ সদস্য
সম্পাদনা: আশিক রহমান