নতুন বাজেটে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ ভাবনা
মো. আবদুল কুদ্দুস
সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী বিনির্মাণে একটি সহজ ও শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হ”েছ সামাজিক ব্যবসা। সামাজিক ব্যবসায়ের ধারণা মতে, সমাজের সমস্যাসমূহ (নিরক্ষতা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, পরিচ্ছন্নতা, বেকারত্ব, বিপন্ন জলবায়ু, দূষণ, মানবাধিকার ইত্যাদি) চিহ্নিত করে উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল চিন্তাধারার সাহায্যে সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ খুঁজে বের করে জনগণের সর্বাধিক কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়। এ ব্যবসার প্রধান উদ্দেশ্য হলোÑ সামাজিক ভ্যালু সৃষ্টি করা, মুনাফা অর্জন নয়। একটি সুষ্ঠু, সুন্দর শান্তিময় ও বাসযোগ্য পৃথিবী বিনির্মাণে তাই সামাজিক ব্যবসা প্রসারে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।
বাংলাদেশ জাতিসংঘ সহশ্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এমডিজি’স) অর্জনকারী সফল দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারির একটি দেশ। দেশের অভ্যন্তরে উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখার অভিপ্রায়ে সরকার এমডিজিস পরবর্তী জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এসডিজিস) স্বাক্ষর করেছে। এখানে যে ১৭টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলো হলোÑ দারিদ্র্যবিমোচন, ক্ষুধা মুক্তি, সুস্বাস্থ্য, মানসম্মত শিক্ষা, সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, নবায়নযোগ্য ও ব্যয়সাধ্য জ্বালানি, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি, উদ্ভাবন ও উন্নত অবকাঠামো, বৈষম্য হ্রাস, টেকসই নগর ও সম্প্রদায়, সম্পদের দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহার, জলবায়ু বিষয়ে পদক্ষেপ, টেকসই মহাসাগর, ভূমির টেকসই ব্যবহার, শান্তি ও ন্যায়বিচার এবং টেকসই উন্নয়নের অংশীদারিত্ব। জাতিসংঘ কর্তৃক উন্নয়নের এই কর্র্মসূচির নাম রাখা হয়েছে, ‘ঞৎধহংভড়ৎসরহম ঙঁৎ ডড়ৎষফ: ঞযব ২০৩০ অমবহফধ ভড়ৎ ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ’. এ দলিল হলো মানব উন্নয়নের দিকদর্শন, যার ভিত্তি ঋরাব চং-চবড়ঢ়ষব, চষধহবঃ, চৎড়ংঢ়বৎরঃু, চবধপব ধহফ চধৎঃহবৎংযরঢ়. এই দলিলে মানুষ বলতে সেই মানুষের কথা চিন্তা করা হয়েছে যারা তাদের সমস্ত সম্ভাবনা ব্যবহার করে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, সম্মান ও সমঝোতার সঙ্গে প”থিবীতে বাস করবে। পৃথিবী বলতে, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই ভোগ ও উৎপাদন, প্রাকৃতিক সম্পদের বজায়যোগ্য ব্যবহার এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবার জন্য ব্যবস্থা থাকবে। সম”দ্ধি বলতে, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হবে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ তাল মিলিয়ে। শান্তি বলতে, শান্তিময় ন্যায়ভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা যার মূল প্রতিপাদ্য হলোÑ শান্তি ছাড়া টেকসই উন্নয়ন হয় না আবার টেকসই উন্নয়ন ছাড়া শান্তি হয় না। অংশীদারিত্ব বোঝাতে, শক্তিশালী বিশ্ব ভাতৃত্বের বন্ধনে সকল দেশ, সব অংশীজন ও মানুষের বিশেষত, দারিদ্র্য ও অরক্ষিত মানুষের অংশগ্রহণে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের একটি বড় অংশীদার দেশ। এ লক্ষ্যে সরকার ২০১৫ সাল পরবর্তী দেশে টেকসই উন্নয়নের উদ্দেশ্যে যে বাজেট সূচিও সাজিয়েছে তার ৬-৮নং অধ্যায়ে টেকসই উন্নয়নের ভাবনা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে বাজেটের সেøাগান রাখা হয়েছে, ‘গধৎপযরহম ঃড়ধিৎফং এৎড়ঃিয, উবাবষড়ঢ়সবহঃ ধহফ ঊয়ঁরঃধনষব ঝড়পরবঃু’. সরকারের এ দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনার দরুণ ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশ, ২০১৩-২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়নের জংশন প্রতিষ্ঠা, ২০৪১ সাাল নাগাদ বাাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা, ২০৭১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ উন্নয়ন বিশ্বে অনুকরণীয় মডেল হবে এবং ২১০০ সালে একটি ডেলটা প্ল্যান ঘোষণা করা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এতসব উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ কিভবে সম্ভব হবে তার জন্য স্পষ্ট রূপরেখা থাকলেও ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরের বাজেটে টেকসই উন্নয়নের জন্য সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগের কোনো ‘পথচিত্র’ তুলে ধরা হয়নি। কিš’ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাংলাদেশে টকসই উন্নয়নের জন্য সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ এমন উদ্যোগ যে তার নকশা তৈরি করা হয় সমাজের সমস্যা সমধানের উদ্দেশ্যে। প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ এখনো ব্যাপকহারে প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলা চলে। এর জন্য আমি আগামী বাজেটে সরকারকে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ সংক্রান্ত নীতিমালা সংযোজনের জন্য কতিপয় সুপারিশমালা পেশ করছি: সুপারিশগুলো হলোÑ (ক) মাধ্যমিক শ্রেণি হতে উচ্চশিক্ষা সকল স্তরে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের পাস করার পর শুধু চাকরি নয়, উদ্যোক্তা হবার মনোভাব গড়ে উঠে, (খ) প্রধানমন্ত্রীর ‘ক্ষুদ্র সঞ্চয়’ মডেলের তত্ত্বীয় কাঠামো উন্নয়ন করে মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে, (গ) সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও ঊীবপঁঃরাব ঈড়সসরঃঃবব ড়ভ ঘধঃরড়হধষ ঊপড়হড়সরপ ঈড়ঁহপরষ (ঊঈঘঊঈ) এর সঙ্গে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন শাখা খুলতে হবে, (ঘ) সামাজিক ব্যবসায় খাতে বিনিয়োগকারীদের সিঙ্গেল ডিজিট সুদের হারে ঋণ প্রদান করতে হবে। কারণ সামাজিক ব্যববসার মূলনীতি মোতাবেক এ খাত হতে উদ্ভুত লাভের অংশ বিনিয়োগকারীদের মাঝে লভ্যাংশ হিসেবে বণ্টন না করে নতুন আরও একটি প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণে খরচ হয়ে থাকবে। ফলে কর্মসংস্থান তৈরি হয়। দারিদ্র্যবিমোচন হয়ে থাকে। সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ যেহেতু দরিদ্র মানুষের কল্যাণে পরিচালিত হয় বলে এই মডেল সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক। সমবেত কণ্ঠে আমরা আওয়াজ তুলিÑ অধিক সামাজিক ব্যবসা, কম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা, সুন্দর পৃথিবী বাসযোগ্য শান্তিময় প”থিবী।
লেখক: শিক্ষক, বিজনেস স্টাডিজ বিভাগ ও সহকারী প্রক্টর, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী
সম্পাদনা: আশিক রহমান