আইনটি কার্যকর না হওয়া নিয়ে প্রশ্ন
ইকতেদার আহমেদ
পৃথিবীর সকল উন্নত ও অধিকাংশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে শহরসমূহকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখার নিমিত্ত সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্যকোনো স্থানে দেয়ালে লিখন বা পোস্টার লাগানো যায় না। এ সকল রাষ্ট্রে বিষয়টি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সাধারণত দেখা যায়, শহরকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখার সেবামূলক দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানোর বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ ধরনের স্থানীয় কর্র্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে কেউ দেয়ালে লিখতে বা পোস্টার লাগাতে চাইলে তাকে নির্ধারিত হারে সংস্থাটির বরাবরে অগ্রিম অর্থ প্রদান করতে হয়। এর ফলে দেখা যায়, দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানো খাত থেকে স্থানীয় কর্র্তৃপক্ষ তার উন্নয়ন ব্যয়ের আংশিক উপার্জন করে থাকে। আর অপরদিকে দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানোর জায়গা নির্ধারিত করে দেওয়ায় শহরের অপরাপর স্থানের সৌন্দর্য হানির কোন অবকাশ সৃষ্টি হয় না।
আমাদের দেশে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে যেকোনো জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনের সময় দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানোর কাজটি অধিক সংগঠিত হয়। এ সময় নির্বাচনি এলাকার শহরাঞ্চলের এমন কোনো দেয়াল অবশিষ্ট থাকে না যা দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানো হতে মুক্ত। দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানো শহর বা নগরের সৌন্দর্য হানি ঘটানো ছাড়াও এগুলোকে অপরিচ্ছন্ন করে তোলে। এ বিষয়টির যথার্থতা অনুধাবন করতঃ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও দলের জন্য ১৯৯৬ খ্রি. প্রণীত আচরণ বিধিমালায় নির্বাচনকালীন দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানো নিষিদ্ধ করতঃ এর লঙ্ঘনের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান করা হয়। এ আচরণ বিধিমালাটি পরবর্তীতে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত আচরণ বিধিমালা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনসমূহ একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। উপরোল্লিখিত আচরণ বিধিমালাটির কারণে নির্বাচনকালীন নির্বাচন সংশ্লেষে দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানো বারিত হলেও তা নির্বাচন বহির্ভূত যেকোনো বিষয়ে দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানোয়ে বাধা হিসেবে দেখা দেয় না। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানোর কারণে আমাদের শহরাঞ্চলের দেয়াল ছাড়াও বিভিন্ন উড়াল সেতুর পিলার, লাইট পোস্ট এবং দেয়ালে লিখন বা পোস্টার লাগানোর অবকাশ আছে এমন সকল স্থান দেয়ালে লিখন ও পোস্টার দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে যায়। এর ফলে একদিকে শহরের সৌন্দর্য বিনষ্ট হয় এবং অপরদিকে যত্রতত্র পোস্টারের ছেড়া অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে আবর্জনার উপস্থিতি সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়।
দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানো উপদ্রব হতে শহরকে রক্ষার জন্য আমাদের আইন প্রণেতারা ২০১২ খ্রিস্টাব্দে দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন করে। এ আইনটি ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রণীত হয়ে গেজেট বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশিত হলেও প্রণয়নের তারিখে আইনটির কার্যকারিতা না দিয়ে বলা হয় সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যে তারিখে আইনটি কার্যকর হওয়া নির্ধারণ করবে সে তারিখ হতে আইনটি কার্যকর হবে।
এ আইনটি প্রণয়নের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল তা হলোÑ এর ফলে শহর একদিকে পরিচ্ছন্ন থাকবে এবং অপরদিকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানোর স্থান নির্ধারণ করে দেওয়ায় তা তাদের জন্য কিছু বাড়তি অর্থ আয়ের সুযোগ করে দিবে। কিন্তু দেশবাসী অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে, আইনটি প্রণীত হওয়ার পর ৪ বছরেরও অধিক সময় অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত এটি কার্যকর সংক্রান্ত কোনো গেজেট বিজ্ঞপ্তি সরকারের পক্ষ হতে প্রকাশ করা হয়নি। স্বভাবতই দেশবাসীর মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে কাদের স্বার্থে আইনটি কার্যকর করা হচ্ছে না? আমাদের দেশে প্রিন্টিং প্রেস ব্যবসা এবং রংতুলি নিয়ে যারা ব্যবসা করেন দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানো অবারিত হওয়ায় সারাবছরই তাদের ব্যবসা জমজমাট থাকে। এ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকে এ আইনটি কার্যকর করা হলে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ অজুহাত দেখিয়ে আইনটি কার্যকর সংক্রান্ত গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে সংশ্লিষ্টদের উপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। এ প্রভাব বিস্তার যে সংশ্লিষ্টদের জন্য দক্ষিণা শূন্য নয় তা দায়িত্বশীল সূত্র প্রিন্টিং প্রেস ও রংতুলির ব্যবসার সঙ্গে জড়িদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হতে পেরেছে।
দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন যত দ্রুত কার্যকর করা হবে তত দ্রুতই নগরবাসী এর নেতিবাচক প্রভাব হতে মুক্ত হবে। একটি আইন প্রণয়ন পরবর্তী যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে এটির কার্যকারিতা সংক্রান্ত গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ রাখা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর তাই নগরবাসীকে দেয়ালে লিখন ও পোস্টার লাগানোর উপদ্রব হতে নিষ্কৃতি দেওয়ার জন্য আর কালবিলম্ব না করে আইনটি কার্যকর হওয়া সংক্রান্ত গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হওয়া অত্যাবশ্যক।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
রশঃবফবৎধযসবফ@ুধযড়ড়.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান