যে কারণে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি
ডা. ইমরান এইচ সরকার
বনানীর দ্য রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষিত হয়েছে। প্রতিকার চেয়েও পায়নি। এটা অগ্রহণযোগ্য। একজন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ মামলা করতে গেলে পুলিশ যদি এমন ব্যবহার করে তাহলে কীভাবে কি হবে। বিশেষ করে মামলার আসামিরা যদি উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান হয় সেক্ষেত্রে বরাবরই এ ধরনের ঘটনা আমরা দেখে আসছি। তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গেলে বাদীপক্ষকে নানানভাবে ঝুলিয়ে রাখা, মামলা থেকে নিভৃত করার চেষ্টা করা হয়। এটা কোনোভাবেই আইনের শাসনের জন্য সহায়ক নয়। তার মানে এটাই প্রমাণিত হয় যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ বা দৃষ্টিভঙ্গি ধনী আর গরিবের ক্ষেত্রে আলাদা। ঠিক এই জায়গায় যদি বাদীরা নিম্ন শ্রেণি বা নিম্ন আয়ের মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করত বা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করত তাহলে কিন্তু এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। অনেক সময় দেখা যায় পুলিশ নিজেই মামলাটি লিখে দিচ্ছে। কিন্তু যেহেতু এখানে আসামিরা ক্ষমতাধর, পয়সাওয়ালা সে কারণে তাদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে গড়িমসি। মামলার ভবিষ্যৎ এখান থেকেই বোঝা যায়। মামলা নিতেই পুলিশের এত গড়িমসি, এত সময় নিচ্ছে। পুলিশ এমন কাজের মাধ্যমে আসামিদের পালানোর সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। মামলার ভবিষ্যৎ কিন্তু আগে থেকেই অনুমান করা যায়।
দেশের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির জন্য এই দৃষ্টিভঙ্গিই দায়ী। আমরা দেখছি একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, বিচারহীনতার ঘটনা দেখছি। একজন পিতা তার শিশুকন্যার ধর্ষণের বিচার না পেয়ে রেললাইনে ঝাঁপিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। একটি স্বাধীন, সভ্য দেশে এমন ঘটবে কেউ প্রত্যাশা করে। এমনটি ভাবা যায়। যা আমরা চাই না, তাই হচ্ছে এখানে। এসব ঘটনা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথকে রুদ্ধ করে।
কেন বারবার এমন বর্বর ঘটনা ঘটছে এখানে? কারণ আমাদের দেশে সুষ্ঠু বিচার নেই। সাধারণ মানুষ কোনো বিচার পাচ্ছে না। একের পর এক অন্যায় ঘটে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে, তার প্রতিকার তারা পাচ্ছে না। আমরা একই জিনিস দেখেছি তনু হত্যার ক্ষেত্রেও। সারা দেশের মানুষ আন্দোলন করেছে, তবু তনু হত্যার সুষ্ঠু বিচারটি এখনো হয়নি। একটা ধর্ষণের বিচার তো সাধারণভাবেই হওয়ার কথা, এখানে তো আন্দোলন করার প্রয়োজন পড়ে না। অথচ সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নামল তনু হত্যার বিচারের দাবিতে, অথচ বিচারটি হলো না এখনো। মেডিকেল রিপোর্টে এমনিতেও অনেকসময় ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না, এটা অনেক কারণেই অন্য রিপোর্ট আসে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, ধর্ষণ হয়নি। মেডিকেল রিপোর্ট যদি নেগেটিভও আসে, তাতে কিন্তু এটা প্রমাণ করে না যে, ধর্ষণ করা হয়নি।
ধর্ষণ রিপোর্টে প্রমাণিত না হলেও যুক্তিতর্ক ও তথ্যের ভিত্তিতেই তা প্রমাণ হতে পারে। মেডিকেল রিপোর্ট কিন্তু একমাত্র বিষয় নয় ধর্ষণ প্রমাণ করার। তা ছাড়া এমনিতেই ক্ষমতাবান মানুষের বিপক্ষে গেলে ধর্ষণের প্রকৃত প্রতিবেদনও অনেকসময় পরিবর্তন করা হয়ে থাকে! তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী রিপোর্টও পাল্টানো যায়। এ ছাড়া কয়েকদিন ধরে আমরা পত্রিকায় দেখছি, একজন মন্ত্রীর ছেলের সঙ্গেও এক ধর্ষকের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তার মানে তাদের জন্য কোনো বিষয়ই না এ ধরনের রিপোর্ট পরিবর্তন করার। আমি মনে করি, এখানে অপরাধী যেই হোক না কেন, ধর্ষকদের ব্যাপারে একদম কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। বিচারকে এখানে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন করে দিতে হবে, যাতে কোনোভাবেই কেউ এ ধরনের ঘটনার বিচারকে প্রভাবিত করতে না পারে।
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্সের কথা বলি। আমরা তা সমর্থনও করি। ধর্ষণের মতো ঘটনার ক্ষেত্রেও জিরো টলারেন্স অবস্থান জরুরি। অপরাধী প্রভাবশালী হলেও তাদের যদি বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায় তাহলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটাই কমে আসবে। নিরাপদ, ভয়মুক্ত, প্রগতিশীল, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে, লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নত দেশ গঠনের স্বার্থেই ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।
পরিচিতি: মুখপাত্র, গণজাগরণ মঞ্চ
মতামত গ্রহণ: সাগর গনি/সম্পাদনা: আশিক রহমান