ষোড়শ সংশোধনী মামলার আপিল শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল সব বিচারপতিরা না থাকলে নিজেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবো
এস এম নূর মোহাম্মদ : বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানিতে আপিল বিভাগে আস্থাহীনতার কথা বললেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আাপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি করাকে কেন্দ্র করে গতকাল মঙ্গলবার এই অনাস্থার কথা বলেন তিনি।
আপিল বিভাগের কার্যতালিকার তিন নম্বর ক্রমিকে অন্তর্ভুক্ত ছিল মামলাটি। সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতির বেঞ্চ বসে। শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল দুটি আবেদন জমা দেন। এর মধ্যে একটি হলো বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি আসা পর্যন্ত শুনানি মুলতবি রাখা। আর অপরটি হচ্ছে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড রয়েছে তাদের তালিকা চাওয়া। আবেদন জমা দেওয়ার পর আপিল বিভাগ শুনানি শুরু করতে বলেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আগে তো বলেছিলেন ৭ জনই থাকবে। বাকি ২ জন না আসা পর্যন্ত সময় দেন। এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা তো বলেছি, মামলাটি কন্টিনিউ শুনানি করবো। আর যখন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন হবে, তখন আপিল বিভাগের সকল বিচারপতি এতে অংশ নেবেন। এই নিয়ে আপনাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের বিষয়টি জাতীয় সংসদের হাতে নাকি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে থাকা উচিত তা নির্ধারণ হওয়া দরকার।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনি তো আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত আছেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, এ মামলার সঙ্গে বিচারকদের শৃংখলার বিষয়টি জড়িত। এক্ষেত্রে কোনো শূন্যতা থাকতে পারে না।
এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপিল বিভাগে এখন বিচারপতির সংখ্যা ৭ জন। কিন্তু শুনছেন ৫ জন। আপনারা বলেছেন যে সবাই শুনবেন। আজ তা শুনছেন না। এভাবে চললে আমি অনাস্থা দিতে বাধ্য হবো। নিজেকে এ মামলার শুনানি থেকে প্রত্যাহার করবো।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি আদালতকে খাটো করে (আন্ডার মাইন্ড) দেখছেন। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি অসহায়। এভাবে শুনানি অব্যাহত রাখলে ন্যায়বিচার হবে না। শুনানিতে অংশ নিতে আমাকে বাধ্য করবেন না। আমাদের আবেদন, হাইকোর্টের রায়ে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে কিছু মন্তব্য করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বৈরি কিছু থাকলে সেটা আমরা দেখবো। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রায়ে অনেক কথা আছে। এসময় বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিয়া বলেন, এখনও তো মামলা শুনলামই না। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি শুনানি বিলম্ব করছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমাদের আরেকটি আবেদন আছে। পৃথিবীর কোনো দেশেই বিচার বিভাগ (হাইকোর্টের রায় প্রসঙ্গে) এভাবে কথা বলতে পারে না।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি আদালতকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন যে নিজেই বিপদে পড়বেন।
এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনি কি আমাকে থ্রেট করছেন? গতকাল বলেছেন যে সবাই শুনবেন। কিন্তু তাতো দেখছি না। আমরা তো আদালতকে সহযোগিতা করতে চাই। প্রধান বিচারপতি বলেন, হাইকোর্টের রায় উপস্থাপন করতে সমস্যা কোথায়? আপনি লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করুন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনি বলেছিলেন যে ৭ জনই শুনবেন। কিন্তু এখন তা শুনছেন না। আমি তো বলেছি মে মাসেই শুনানি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এভাবে হলে তো আমি এ মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবো।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি ইনসিস্ট (পীড়াপিড়ি) করছেন কেন? এরপরও প্রধান বিচারপতি রায় উপস্থাপন করতে বললে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রায় উপস্থাপন করবো। তবে আমাকে সময় দিতে হবে। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা আগে বলেছিলাম লিখিত যুক্তিতর্ক প্রস্তুত করে তা দাখিল করতে। আপনার দপ্তরে একশ ৫৫ জন আইন কর্মকর্তা আছেন। তাই এটা প্রস্তুত করতে এতো সময় লাগবে কেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, দুই সপ্তাহ সময় চেয়েছি। আশা করছি এ সময়ের মধ্যে উনারা (বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) ফিরে আসবেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি হাইকোর্টে শুনানি করেছেন। আপনার সব মনে থাকার কথা।
বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিয়া বলেন, আপনি আদালতের প্রধান আইন কর্মকর্তা। তাই মামলা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা বলা ঠিক হয়নি। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি নিরুপায় হয়ে বলেছি। আপনারা যখন ৫ জন শুনবেন বলেছেন তখন এটা বলেছি।
এরপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা পেপারবুক থেকে পড়া শুরু করেন। বিরতির পর আবারও মুরাদ রেজা পেপারবুক থেকে পড়েন। তার বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, মি.অ্যাটর্নি জেনারেল, আপনারা একজনের জাজমেন্ট সাপোর্ট করবেন কি না? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা অপ্রয়োজনীয়। এটা জবাব দেওয়ার কিছু নেই। আমরা সবাইকে চাচ্ছি। এপর্যায়ে বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া বলেন, কাল তো আপনি বহুত রকম নাটক করেছেন। আজ তো দেখছি না। প্রধান বিচারপতি বলেন, রোববার পরবর্তী শুনানি রাখি। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনার আদেশ শিরধার্য। তবে রোববার রাখলে পারবো না। একটু সময় দেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, গতকাল (সোমবার) সিনিয়র আইনজীবী টিএইচ খান উপস্থিত ছিলেন। আজ ড. কামাল হোসেন, এমআই ফারুকী আছেন। এ পর্যায়ে ড. কামাল হোসেন দাঁড়িয়ে বলেন, আমি লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করেছি।
এসময় ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও ড. আবদুল ওয়াদুদ ভুইয়া অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে লিখিত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। পরে প্রধান বিচারপতি বলেন, আশা করি বাকি যারা আছেন তারাও দাখিল করবেন। এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, ১৪ মে সাড়ে ১১টায়। এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি পারবো না। আপনারা তো সব মামলায় সকল পক্ষের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। এ মামলায় সেটা করছেন না কেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি করতে বাধ্য হচ্ছি। অনেকগুলো প্রশ্ন জড়িত। প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে। এখানে বিচারকদের শৃংখলার বিষয়টি জড়িত। সুপ্রিম কোর্ট এই সংবিধানের অভিভাবক। আমাদেরকে একদিকে যেতে হবে। আমি আপনার কথা রাখলাম। মাঝপথে রাখছি। আগামী ২১ মে সাড়ে ১১টায়।
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি খুব আনন্দিত হবো সবাইকে নিয়ে শুনানি করলে। প্রধান বিচারপতি বলেন, সবাইকে নিয়ে শুনতে হবে এমন শর্ত দেওয়া যায় না। অনেকগুলো কারণ থাকে তো। একজন অসুস্থ হলে, বিদেশে গেলে আপনি কি করবেন? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, জুলাই পর্যন্ত দেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, সে পর্যন্ত অসুস্থ হলে আপনি কি করবেন? আপনি কন্ডিশন দেবেন না। আপনি প্রেয়ার দিতে পারেন। ইনসিস্ট করতে পারেন না। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সবাইকে যুক্ত করতে চাচ্ছি। সবার মন মুক্ত করতে চাচ্ছি। প্রধান বিচারপতি বলেন ঠিক আছে। থ্যাঙ্ক ইউ। এরপর আদালত উঠে যান। সম্পাদনা : গিয়াস উদ্দিন আহমেদ