আর কত বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হলে মানবতাবোধ জাগবে!
অরুণ কুমার বিশ্বাস
অশীতিপর এক বৃদ্ধ লাঠিতে ভর দিয়ে টুকটুক করে হাঁটছেন। পরনে রঙচটা ফতুয়া ও হালকা বাদামি লুুঙ্গি। চোখে ঘোলাটে দৃষ্টি, তোবড়ানো গালে হতাশার ছায়া স্পষ্ট। তিনি একজন বাবা, একসময় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন। এখন তার ছোট্ট একটুখানি মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে আগারগাঁওয়ের সরকারি বৃদ্ধনিবাসে। অথচ এক সময় তিনি হলভর্তি তরুণ ছাত্রী-ছাত্রীদের সাথে মিলে জ্ঞানসমুদ্রে পরিভ্রমণ করতেন। কত উচ্ছ্বাস কত উদ্দীপনা ছিল এই বুড়ো মানুষটির! অথচ এখন তিনি একেবারেই একা, যেন কোথাও কেউ নেই তার। যেদিকে তাকান শুধু নিরেট আঁধার, নিঃসীম শূন্যতা!
ধরে নিন স্যারের নাম আব্দুল জলিল। স্যার কিন্তু এমন একাকী আগে ছিলেন না, তার দুটো ছেলে, একটি মেয়েও ছিল। ছিল বলছি কি, আছে এখনো। তবে আজ তারা স্যারের ধারেকাছেও নেই। ইচ্ছে করেই ছিটকে গেছে দূরে-বহুদূরে। স্যারের অপত্য স্নেহ ওদেরকে আর স্পর্শ করতে পারে না। বলা বাহুল্য, আমাদের এই জলিল স্যার কিন্তু বরাবরই ভীষণ অবৈষয়িক। তিনি ভাবতে পারেননি, বেঁচে থাকার জন্য জ্ঞানের বাইরেও কিছু দরকারÑ বিশেষত জমিজমা বা টাকাকড়ির মতোন জিনিস। স্যার তো পদার্থবিদ্যা পড়তেন, এই বিদ্যা শেখাতে শেখাতেই কি তিনি অপদার্থ হয়ে গেলেন! নাকি তার ছেলেমেয়েরা বাবাকে নিতান্তই তুচ্ছ মনে করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে তাদের জন্মদাতাকে!
অতীতের কথা তুলতেই স্যার বড্ড স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন। তার নাকি একসময় সাজানো গোছানো সংসার ছিল। যদিও তিনি সংসারের সারবত্তা কখনো উপলব্ধি করতে চাননি। পড়ালেখাই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। সেই অর্থে তিনি জ্ঞানতাপস, একজন রাজর্ষি মানুষ। স্ত্রী মারা গেছেন অনেক আগে। তারপর ছেলেমেয়েরা বাপের খুব খাতির-যতœ করতে শুরু করে। স্যার খুশি হন, স্ত্রী নেই তো কী হয়েছে! ছেলেরা তো আছে। বাকি দিনগুলো নাতি-নাতনিদের নিয়ে কাটাবেন! মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। স্যার বোধ হয় বুঝতে পারেননি, তিনি শিক্ষক হিসেবে যতটা সফল, বাবা হিসেব ঠিক ততটাই অসফল। নইলে যাদের জন্য তিনি নিজের জীবনের সকল সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে অর্থব্যয় করেছেন, সেই ছেলেরা কেন তাকে এই অসময়ে এভাবে একলা ছেড়ে চলে যাবে!
শোনা যায় তার বড় ছেলে বিলেতে গিয়ে জমিয়ে বসেছে। হোটেলব্যবসা করে মেলা টাকা রোজগার করছে সে। ছোট ছেলে এদেশেই আছে, কিন্তু বাবার কথা উঠলেই সে মশা-মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে প্রসঙ্গ বদলে উঠে পড়ার প্রস্তুতি নেয়। জলিল স্যার সবচে বড় ভুল করেছেন শেষ বয়সে যখন দেখলেন তার জমিটুকু লিখিয়ে নেবার জন্য ছেলে-বউয়েরা তাকে এক্সট্রা খাতির করতে শুরু করেছেন, তখনো তিনি সজাগ হননি। তার ঘরভর্তি কিছু অকৃতজ্ঞ নেমকহারাম বেড়ে উঠেছে, এটা বুঝি স্যার ভুলেও বুঝতে পারেননি। সন্তানের প্রতি সবটুকু অপত্য ভালবাসা ঢেলে দিয়ে বড় করেছেন ওদের।
সাহস সঞ্চয় করে বলি, স্যার, ছেলেরা আপনার খোঁজ নেয় না? নেবে না কেন, নেয় তো! বৃদ্ধনিবাসের গেটে এসে জেনে যায়, আর কতদিন বেঁচে থাকব আমি! কেন এমন ভূষ-ির কাকের মতো দীর্ঘকাল বেঁচে আছি, এই নিয়ে ওদের আপসোসের অন্ত নেই।
বেশ বুঝতে পারি, অভিমানি সুরে কথা বলছেন জলিল স্যার। দীর্ঘশ্বাস চেপে তিনি বললেন, আমি সবচেয়ে বড় ভুলটা কখন করেছি জানো, পেনশনের কিছু টাকা জমানো ছিল। ছেলে আর বউদের চাপাচাপিতে শেষে একরকম বাধ্য হয়ে পুরো টাকা তুলে ভাগ করে দিই। অবাক বিস্ময়ে দেখি ওরা আমার ছেলে নয়, যেন দুটো কাক রুটি নিয়ে নির্লজ্জের মতো খেয়োখেয়ি করছে। আমি শরমে মরে যাই। সত্যি বলছি, তখনই আমার বাঁচার ইচ্ছেটা পুরোপুরি মরে গেছে। আমি তো এখন বেঁচে নেই, নিছক জীবন্মৃত।
জলিল স্যারের অপরিসর কক্ষে বেশ কিছু বই। শুধু পদার্থবিদ্যা নয়, আছে সাহিত্য, প্রাণীবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, ক্রিমিনোলজি। বই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এখন। জলিল স্যারকে দেখে মনে হয়, মানুষের সত্যিকারের বন্ধু শুধু বই। এই বন্ধু কখনো কাউকে ঠকায় না, বিশ্বাস ভাঙে না। ছেলেদের দেখতে ইচ্ছা করে না স্যার! বড় মোক্ষম জায়গায় ঘা দিয়ে ফেলি আমি। স্যার কিছু বলেন না। চুপচাপ জানালার বাইরে কী যেন দেখেন! নাকি ছেলেদের মুখ মনে করার অপচেষ্টা মাত্র। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি স্যার এভাবে ভেঙে পড়বেন। সহসাই তাকিয়ে দেখি তার গাল বেয়ে নিঃশব্দে চুঁইয়ে নামছে নোনাজল। একজন অসহায় বাবার অব্যক্ত আকুতি যেন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে তার ঈষদোষ্ণ অশ্রুবিন্দুতে।
আমি স্থাণু হয়ে যাই। নড়তে পারি না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় একজন অধ্যাপকের এ কেমন অযৌক্তিক অসহায়ত্ব! এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা! প্রশ্নগুলো রাতভর আমাকে কুরে কুরে খায়। এখনো যদি আমাদের ন্যূনতম মানবিক চেতনা জাগ্রত না হয়, তাতে দেশজুড়ে শুধু বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যাই বাড়বে, সন্তান হিসেবে আমাদের নিষ্করুণ দায়ভার একটুও কমবে না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রথম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
সম্পাদনা: আশিক রহমান