অর্থনীতি ও সমাজ বিবর্তনের আকর গ্রন্থ
মিল্টন বিশ^াস
ড. শামসুল আলম খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, অন্যতম উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নকারী, কৃষি বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্ট কলাম লেখক এবং জনপ্রিয় টকশো বক্তা। তার নতুন বই ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্মুখপানে বাংলাদেশ’। বইটি ৩৩টি নিবন্ধের সংকলন। তিনি জাতীয় দৈনিকসমূহে উপসম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী কলাম লিখছেন। তার ভেতর বিগত ২-৩ বছরের বাছাইকৃত নিবন্ধসমূহ এই গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে। ড. শামসুল আলম ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে যুক্ত। তিনি বর্তমানে সিনিয়র সচিব। ফলে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়নে ও অর্থনৈতিক নীতি বিশ্লেষণের সঙ্গে যুক্ত থেকে, অর্থনীতি ও সামাজিক খাতের চালকগুলোর বিবর্তন সরাসরি অবলোকন ও পর্যালোচনার সুযোগ পেয়েছেন। এজন্য নির্দ্বন্দ্বচিত্তে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ও উপলব্ধিসমূহ প্রকাশ করেছেন আলোচ্য গ্রন্থের নিবন্ধসমূহে।
২. ড. শামসুল আলমের ৩৩টি নিবন্ধ কয়েকটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। তিনি যেহেতু কৃষিব্যবসা ও বিপণন বিষয়ে অভিজ্ঞ এজন্য এ গ্রন্থে কৃষি-অর্থনীতি নিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ সংকলিত হয়েছে। বিশেষত বাংলাদেশের ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি প্রসঙ্গ অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। কৃষি খাতে নতুনত্ব আনয়ন, বাজেটের পর কৃষিখাতে সম্ভাব্য প্রভাব কিংবা কৃষিখাতের চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়েও তার গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা রয়েছে। তার মতে, ‘কৃষিখাতের অগ্রগতির জন্য কৃষি বিষয়ক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার বিকল্প নেই।’(পৃ. ১৮৩) বাজেটের সঙ্গে কৃষিখাতের সম্পর্ক নির্ণয়ে তিনি কৃষি সংশ্লিষ্ট খাতসমূহে রাজস্ব ও উন্নয়ন বরাদ্দ এবং কর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
মুদ্রানীতি নিয়ে ড. শামসুল আলমের সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ পেয়েছে যথাক্রমে ‘গতানুগতিকতার সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারেনি ২০১৬ মুদ্রানীতি’, ‘কী লক্ষ্যে প্রণীত হবে ২০১৭ মুদ্রানীতি’, ‘নীতি পর্যালোচনা : প্রবৃদ্ধি সহায়ক মুদ্রানীতিই এখন প্রাসঙ্গিক’ নিবন্ধসমূহে। তিনি সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতির পক্ষে লিখেছেন এভাবেÑ ‘রাজনৈতিক-অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও এটা বলা যায়, যেকোনো পাঁচ বছর মেয়াদি নির্বাচিত সরকারের উচিত প্রথম তিন বছর প্রবৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া, মানে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা।’(পৃ. ১১১) আধুনিক এবং বৈশি^ক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দেশের মুদ্রানীতি প্রবর্তিত হওয়ার পক্ষে তার মত। তিনি যে রাজনৈতিক-অর্থনীতির কথা বলেছেন তার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা বর্ণিত হয়েছে। প্রথম প্রবন্ধ ‘উন্নত বাংলাদেশ : স্বপ্ন ও সম্ভাবনা’তে রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ এর উদ্দেশ্য বিবেচনায় নিয়ে ‘টেকসই উন্নয়নে’র অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের কথা লিখেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় লক্ষ্যের সামঞ্জস্য দেখেছেন আন্তর্জাতিক উন্নয়নের সূচকের ভেতর। ড. শামসুল আলমের লেখনি সূত্রে আমরা ‘ডেল্টা প্ল্যান’ বা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এই মহাপরিকল্পনা ২১০০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে। স্থানিক ও কালিক ব্যাপ্তিতে এটি ব্যাপক এবং দেশের ইতিহাসে প্রথম। ব-দ্বীপ পরিকল্পনার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। ৫০ থেকে ১০০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা দিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় রূপান্তর করা হবে। এজন্য তিনি স্মরণ করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। তার ‘বঙ্গবন্ধু : উন্নয়নের কা-ারি’ নিবন্ধে পরিকল্পনা কমিশন গঠনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে স্মরণ করেছেন। কারণ ‘বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার পরিকল্পিত বাস্তবায়ন ও উপর্যুক্ত থিংকট্যাংক হিসেবে তিনি পরিকল্পনা কমিশনকে গঠন করেছিলেন।’(পৃ. ১১৫) বর্তমানে এই কমিশনটি দেশকে এগিয়ে নেবার সকল সফল প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। নেতৃত্বে আছেন অর্থনীতিবিদরা। লেখকের মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ যদি এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাসমূহ পূরণ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।’(পৃ. ৪৭) ‘উন্নয়নে এগিয়ে যাব কাউকে পেছনে রেখে নয়’ শিরোনামের নিবন্ধে এসবই বিস্তৃত পরিসরে লিখেছেন তিনি।
ড. শামসুল আলমের ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্মুখপানে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে পানি ব্যবস্থাপনায় দেশজ পরিকল্পনা নিয়ে চমৎকার যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি দারিদ্র্য নিরসনে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমন্বিত পরিকল্পনার কথা বলেছেন। ছাত্র রাজনীতিতে লেজুড়বৃত্তি পরিহারের পক্ষে তিনি। তিনি জনগণকে জিম্মি করে রাজনীতি করার বিপক্ষে এবং আওয়ামী লীগের করণীয় সম্পর্কে কথা বলার সময় দলকানার মতো কথা বলেননি এই লেখক। নিরপেক্ষ এবং যুক্তিনিষ্ঠ ও পথপ্রদর্শকের মতো কাজ করেছেন তিনি লেখনির মাধ্যমে। সর্বোপরি তিনি প্রযুক্তির বৈপ্লবিক চাহিদাকে উচ্চে তুলে ধরেছেন। আর দেশের অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জসমূহকে পাঠকের সামনে নির্মোহ দৃষ্টিতে তুলে এনেছেন। উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য ড. শামসুল আলমের নিবন্ধসমূহ রাজনীতিবিদদের সচেতন করবে এবং সাধারণ পাঠককে দেশের উন্নয়নের পিছনে চলমান অনেক ঘটনার মুখোমুখি দাঁড় করাবে। কেবল অর্থনীতি নয় তিনি একই সঙ্গে ভেবেছেন সমাজ নিয়ে। ফলে অর্থনীতি ও সমাজ বিবর্তনের চলমানতাকে যারা তথ্য-উপাত্তের মণিকাঞ্চনে উপলব্ধি করতে চান তাদের জন্য অনন্য গ্রন্থ ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্মুখপানে বাংলাদেশ’। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান