ধর্ষকদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে
বনানীতে দুই ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা অত্যন্ত অরুচিকর ও খুবই দুঃখজনক। আমরা যে কথাটা বারবার বলছি সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে, সমাজে অপরাধ ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। শুধু বেড়ে যাচ্ছে না, অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। আগে একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র বা ছাত্রীর ভেতরে অসম্ভব রকম নৈতিকতার বিষয়টি ছিল, আদর্শের জায়গা দেখেছি, সততার জায়গাটি দেখেছি। এখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে বারবার অনেক প্রশ্ন উঠছে। আমরা বলেছি, ভোগবাদী, পুঁজিবাদী সমাজের খারাপ উপাদানগুলো আমাদের সমাজে অনেক বেশি ঢুকে গেছে। আকাশ সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে … ইনফরমেশন থাকবে, মুক্ত চিন্তাধারা আসবে। কিন্তু তার সঙ্গে পুঁজিবাদী বা ভোগবাদী সমাজের যে কুৎসিত দিকগুলো এবং অপরাধের যে বৈচিত্র্যগুলো ঢুকে যাচ্ছে, পৈশ্বাচিকতা ঢুকে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, বনানীর ঘটনাটি আরেকটি প্রমাণ। আমারই বন্ধু বা সহপাঠী মিথ্যা কথা বলে জন্মদিনের নাম করে একটি হোটেলে নিয়ে যাওয়া, এটা আসলে সমাজ ব্যবস্থার যে অসহিষ্ণতা, সামাজিক মূলবোধের প্রচ- রকম ধস নেবে যাচ্ছে। সেই জায়গাটা আসলে আমার মনে হয় আমাদের দেখা উচিত।
এ জায়গাটা আমি দুদিক থেকেই দেখি। এক. যেসব ছেলে এগুলো করছে তারা কোন পরিবারের, তারা কি অভিজাত বা প্রভাবশালী পরিবারের? আমরা সবসময় দেখেছি এগুলোকে ধামা-চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ঠিক একইভাবে আমি আরেকটি কথা বলব, আমাদের মেয়েরা এ ধরনের ভুলগুলো বারবার কেন করছে? চূড়ান্তভাবে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একজন বন্ধু তাদের হোটেলে ডাকল আর সেখানে চলে গেল? এটা আমার কাছে খুব নতুন মনে হচ্ছে। একজন সহপাঠী হোটেল বা রেস্তোরাঁয় ডেকে নিয়ে যাচ্ছে, সেটি ভালোমতো ভেরিফাই করা উচিত ছিল, যে বন্ধুটির জন্মদিন সত্যিই পালিত হচ্ছে কিনা। পার্টিতে আরও কে, বা কারা যাচ্ছে। অন্য সহপাঠীরা সেখানে যাচ্ছে কিনা এ বিষয়গুলো নিয়ে মেয়েদেরও ভাবা উচিত ছিল। আমার ছাত্রী সমতুল্য মেয়েদের বলতে চাই, তোমরা ভেরিফাই করো, বন্ধুরা ডাকলেই কোথাও চলে যেও না। কারণ নিরাপত্তার একটা ব্যাপার থাকে। এটা আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের সমস্যাটাও ওই জায়গায়। আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতিকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে যাচ্ছি।
আকাশ সংস্কৃতিকে অনুসরণ করার কারণে চূড়ান্তভাবে আমাদের মেয়েরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মেয়েদেরই আকাশ সংস্কৃতির খারাপ দিকটির শিকার হতে হচ্ছে। ছেলেরা যেসব কা-কীর্তি করছে সেগুলো এক ধরনের বিকৃত কর্মকা-। একই সঙ্গে মেয়েদেরও বলব, তোমাদেরও একটু সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ পত্রপত্রিকায় বিস্তরিতভাবে দেখা যাচ্ছে, এ সমস্ত ঘটনা প্রায় ঘটছে। এ বিষয়ে সদা সতর্ক থাকতে হবে। নৈতিকতা, সততা, আদর্শের জায়গাটিতে আমাদের যেতে হবে। আদর্শের জায়গায় না থাকলে আমাদের সামনে অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে।
বন্ধুত্বের সম্পর্কে একটা পবিত্রতা আছে, সেটা ক্রমান্বয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা সমাজের কুৎসিত বাস্তবতাকে তুলে ধরছে। এগুলো নতুন নয়, হরহামেশাই ঘটছে। সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলব, অপরাধী যত বড় প্রভাবশালীই হোক না কেন, যত বড় রাজনৈতিক এবং আর্থিকভাবে প্রভাবশালী হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এখানে মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়ার উচিত ঘটনাগুলো উন্মোচিত করা। ধর্ষণের শিকার মেয়েগুলো সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। তারা ঘটনাটি গোপন করেনি, সমাজ বা মিডিয়ার সামনে নিয়ে এসেছে।
একটি মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে, তাকে তার বন্ধু বা সহপাঠী ডেকে নিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে, এটা তো অচিন্তনীয়। ধর্ষকদের শাস্তি যাবজ্জীবন অথবা ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি শাস্তি হতে হবে। এ অপরাধের কোনো ক্ষমা হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজ নষ্ট হবে ভেবে অনেকে এ রকম ঘটনা লুকাতে চান। এটা সঠিক অবস্থান নয়। এটাও একটা অনৈতিক কাজ এবং বড় ভুল সিদ্ধান্ত। যেহেতু আমাদের সমাজ পুঁজিবাদের দিকে এগোচ্ছে এবং আমরা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ছেলে-মেয়েদের মেলামেশাতে সহজ করে নিয়েছি। নারী-পুরুষ একই জায়গা অবস্থান করবে। কিন্তু অবস্থান করলেই যে পশুত্ব জেগে উঠবে এটি যাতে না হয়ে ওঠে সেই শিক্ষা দিতে হবে।
চূড়ান্ত কথা হচ্ছে, ধর্ষকদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ধর্ষকদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। ধর্ষক যেন সমাজের কাছে চিহ্নিত হয় শত্রু হিসেবে, অপরাধী হিসেবে পরিচিত হয় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এটাও একটা শাস্তি। অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিতে মিডিয়ার শক্তিশালী ভূমিকা রাখা উচিত বলে আমি মনে করি।
পরিচিতি: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত গ্রহণ: তানভীন ফাহাদ
সম্পাদনা: আশিক রহমান