বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
মার্কিন তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৪) যিনি ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে (১৮০১ থেকে ১৮০৯) দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তার বিখ্যাত উক্তি ‘যদি কোনো সমাজে মিডিয়া ও সরকারের মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হয়, মুক্ত মনের মানুষদের সুস্থ পছন্দ হিসেবে বেছে নিতে হবে মিডিয়াকে।’ মিডিয়াকে সরকারসহ সকল প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে মিডিয়ার স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে বলা আছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণœ করে এমন কোনো আইন কখনো মার্কিন কংগ্রেস পাস করবে না। সংবিধানে যুক্ত এই আইনটি হলো মার্কিন মিডিয়ার রক্ষাকবচ। শ্লীলতা-অশ্লীলতা, নৈতিকতা কোনো অজুহাতেই আমেরিকায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণœ করা যাবে না। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। একই অনুচ্ছেদে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে মার্কিন বাকস্বাধীনতা যতটা শর্তমুক্ত, আর্থসামাজিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতায় কিছুটা শর্ত আরোপ করা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনের প্ররোচণা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দান করা হইল’ {বাংলাদেশ সংবিধান, অনুচ্ছেদ: ৩৯(২)}। প্রত্যেক দেশের সংবিধান তার দেশবাসীর আশা-আকাক্সক্ষা, ভাবাবেগ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে। তাই প্রত্যেক দেশের নিজস্ব সংবিধান থাকে। অন্যথায় ধর্মগ্রন্থের ন্যায় সকল দেশের সংবিধানও একটাই হতো। বাকস্বাধীনতা বা ব্যক্তি স্বাধীনতার মাত্রা পরিমাপের মাপকাঠি প্রত্যেক দেশে ভিন্ন। যেমনটি শিশুশ্রম ইউরোপ আমেরিকায় একেবারেই নিষিদ্ধ, কারণ ওই সকল দেশে প্রয়োজনে শিশুর দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করে। আমাদের দেশে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হলে বহু শিশু না খেয়েই মারা যাবে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও রিপোটার্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্সের (আরএসএফ) সদ্য প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদনের ভিত্তি বা গবেষণা পদ্ধতি আমাদের জানা নেই। ইউরোপ আমেরিকা একই মানদ-ে আরএসএফ-এর ফ্রিডম ইনডেক্সে তৈরি করা হয়েছে বলে আমার ধারণা। উল্লেখিত ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান দুই ধাপ পিছিয়ে বিশ্বে ১৪৪তম অবস্থান থেকে ১৪৬-এ গেছে। বাংলাদেশে মতো প্রকাশের স্বাধীনতা একেবারে রুদ্ধ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এই বক্তব্য কতটা অন্তসারশূন্য তার প্রমাণ হচ্ছে অ্যামনেস্টি ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে ফলাও করে সংবাদপত্রের শিরোনাম আকারে প্রকাশিত হওয়া। মজার ব্যাপার হচ্ছেÑ অ্যামনেস্টি গণমাধ্যম নিয়ে প্রতিবেদনটি দিল্লি থেকে প্রকাশ করে। তারা বিবিসিকে জানিয়েছে ঢাকাতে আসার ভিসা তাদের দেওয়া হয়নি বিধায় বাধ্য হয়ে দিল্লিতে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভিসা না দেওয়ার বিষয়টি একেবারেই কাল্পনিক এবং এ ধরনের প্রচারণা হঠকারিতামূলক বলে জানানো হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আইটি বিষয়ক অবৈতনিক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ অ্যামনেস্টির এমন প্রতিবেদনের পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে সন্দেহ পোষণ করেছেন। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশের যাবতীয় অপরাধীদের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ ও ২০০৮ সালে বাংলাদেশে মতো প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে এই সংস্থাটি কোনো বিবৃতি দেয়নি।
আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশে যেটা সর্বত্রই চোখে পড়ে সেটা হচ্ছে আইন মেনে না চলার প্রতিযোগিতা। সমাজ জীবনের সর্বত্রই আইন অমান্যের এ প্রতিযোগিতা লক্ষণীয়। ড্রাইভার, হেলপার, ট্রাফিক, আরোহী সবাই আইন লঙ্ঘন করছে। যারা ব্যস্ত রাস্তার মাঝখান দিয়ে মোবাইল ফোন কানে দিয়ে আড়াআড়ি দৌড়াচ্ছে তাদের কথা বলি না। নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার জন্য নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বকে দায়ী করলেও ভোটারদের দায়ী করি না। ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে পুরো গ্রামের মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে লাঠি-সোটা নিয়ে কেন্দ্র দখল করতে এবং মহিলা ভোটারদের পুলিশের সঙ্গে ঢিলাঢিলি করতে দেখেছি। (চলবে-০১)
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান