খবর কাগজবিহীন দিনের আলস্য বিলাস
ড. সা’দত হুসাইন
প্রতি সকালে সংবাদপত্র না হলে আমার চলে না। আমি সাধারণত দিনে টেলিভিশন দেখি না। রাত জাগা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। রাত বারটার সময় টেলিভিশন খুলে পত্রিকার খবর এবং একইসাথে এর ওপর পর্যালোচনামূলক অনুষ্ঠান প্রথমেই দেখে নিই। তারপর বিভিন্ন চ্যানেলে দু-তিনটি সংবাদ প্রচারের অনুষ্ঠান দেখি। দেশ-বিদেশের মূল খরবগুলো সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে চেষ্টা করি। বিশদ সংবাদের জন্য ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ভোরে ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই খোঁজ করি পত্রিকা দিয়ে গেছে কিনা। উত্তর সাধারণত ইতিবাচক হয়ে থাকে। পত্রিকাগুলো সাজিয়ে রাখা হয়। আমি ‘প্রথম আলো’ দিয়ে দিন শুরু করি। এর একটা বড় কারণ হলো, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে প্রথম আলোর বিশেষ চাহিদা রয়েছে। তারা ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমি প্রথম আলো পড়া শেষ করে ফেলি এবং লিভিং রুমে পত্রিকাটি রেখে দিই। ঘুম থেকে উঠে যে যার মতো এটি পড়ে নেয়। অন্য পত্রিকার প্রতি তাদের আকর্ষণ অনেক কম।
আমি প্রতিদিন মোট আট-দশটি খবর কাগজ পড়ি। এতগুলো খবর কাগজ পড়ার একটা বড় কারণ এর অনেকগুলো আমি সৌজন্য সংখ্যা বা কমপ্লিমেন্টারি কপি হিসাবে পাই। দুটি পত্রিকা আমি নিজ খরচে রাখি। দু-একটি পত্রিকা আমাদের অফিস থেকেও রাখা হয়। সকালে একটি পত্রিকা (প্রথম আলো) পড়ে গাড়িতে উঠি। গাড়িতে বসে আর একটি পত্রিকা পড়া শেষ করি। বাকিগুলো অফিসে একে একে পড়ি। অফিসে মোটামুটি সব পত্রিকা পড়া শেষ করি। একটি পত্রিকা রেখে দিই, যাওয়ার পথে পড়ার জন্য। বিকেল পর্যন্ত এমনিভাবে থেমে থেমে চলে আমার পত্রিকা পড়া। গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ, মন্তব্য বা অনুসন্ধান ভিত্তিক খবরগুলো আলাদা করে সন্ধ্যায় বা রাতে পড়ার জন্য রেখে দেওয়া হয়।
পত্রিকার কারণে ছুটির দিনেও নিশ্চিন্ত অলস সময় কাটানোর উপায় নেই। পত্রিকার আকর্ষণ নেশার মতো। সাজানো পত্রিকাগুলো এক দুর্নিবার আকর্ষণ নিয়ে আমাকে টানতে থাকে। একটা পত্রিকা শেষ হলে পরের পত্রিকা পড়ার লোভ সামলানো যায় না। সেটি পড়তে হয়। যেহেতু ছুটির দিন, তাই রসিয়ে রসিয়ে পড়ার অভ্যাসটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এভাবে দেখা যায়, পত্রিকা পড়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি। শেষে দেখা গেছে বেলা দেড়টা-দুটা হয়ে গেছে। এখন মধ্যাহ্ন আহারের সময়। এদিক থেকে বলা যায় খবরের কাগজ আমাকে সকাল থেকে এক ধরনের ব্যস্ত রেখেছে।
এবার মাঝে কাছাকাছি বিরতিতে দুদিন খবরের কাগজ বন্ধ ছিল। যাকে বলে ‘নিউজ পেপার হলিডে’। নিচের গেট থেকে জানানো হলো আজ পত্রিকা দেয়নি। প্রথম ৩০ সেকেন্ড একটু খারাপ লাগল, তাহলে আজ সকাল কাটবে কীভাবে। অফিসও সেদিন বন্ধ। পরক্ষণেই মনে হলো, তাহলে এত তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠার দরকার কী? আরও একটু গড়াগড়ি দিই। অনেক লম্বা সময় ধরে নিশ্চিন্তে গড়াগড়ি দিলাম। এই সম্পূর্ণ কর্মহীন অবসর সময় কাটাতে ভালই লাগছিল। প্রায় ঘণ্টা খানেক, ঘণ্টা দেড়েক এমনিভাবে কাটিয়ে মুখ-হাত ধুতে গেলাম। আজ শেভ করার তাড়া নেই। হাতে প্রচুর সময় রয়েছে। ধীরে সুস্থে আয়েসী লয়ে নাস্তা করলাম। নাস্তার প্রতিটি আইটেম উপভোগ করলাম। আজ নাস্তাগুলোকে মাইক্রোতে হালকা গরম করে নিলাম। অন্যদিন সময় বাঁচাতে গরম করা ছাড়াই অনেক কিছু খেয়ে নিই, যদিও প্রায় সব খাওয়া গরম করে খেতে আমার ভাল লাগে।
নাস্তা খেয়ে এদিক ওদিক করলাম। বাগানের গাছগুলো অনেকদিন দেখা হয়নি। আজ ছাদে গিয়ে গাছগুলোকে দেখলাম। সতেজ সবুজ গাছগুলো দেখতে ভাল লাগছিল। দু-একটি গাছে ফল এসেছে। কবে সে ফল পাড়তে পারব সে সুখচিন্তা করে আরাম পাচ্ছিলাম। নিচে নেমে পড়ার ঘরে ঢুকলাম। অনেকদিন বই-পত্র গোছানো হয়নি। সাম্প্রতিককালে সংগৃহীত বই এবং কাগজপত্র অগোছালো অবস্থায় এখানে সেখানে পড়ে আছে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে এগুলোকে মোটামুটি গুছিয়ে নিলাম। তারপর আবার বিছানায় গিয়ে পা এলিয়ে শুয়ে থাকলাম। বড়ই প্রশান্তি। শোয়া অবস্থায় মাঝে মধ্যে একাজ ওকাজ করার কথা মনে পড়ে। হাতে অনেক সময় আছে, পরে করা যাবে, এমন মনে করে শুয়ে রইলাম। অন্যদিন হলে না-পড়া একটি খবর কাগজ নিয়ে শুয়ে বসে পড়তাম। তাতে কিন্তু ভিতরে ভিতরে ব্যস্ততার অনুপ্রবেশ ঘটত। আজ আর তেমনটি ঘটার আশঙ্কা নেই। প্রগাঢ় বিশ্রাম।
প্রায় বিকালের দিকে হেলে-দুলে উঠে মধ্যাহ্ন আহার সারলাম। আবার বিছানায় এসে খাটের মাথায় বালিশ ঠেকিয়ে আধা হেলানো অবস্থায় শুয়ে সুখ-ভাবনায় নিমজ্জিত হলাম। আজ কাউকে টেলিফোন করলাম না। বাধ্য না হলে টেলিফোন ধরলাম না। সম্পূর্ণরূপে যোগাযোগ বিছিন্ন থাকলাম। সব মিলিয়ে বড় আনন্দে দিনটা কাটল। সন্ধ্যায় ফুরফুরে মেজাজে কোথাও আড্ডা দিতে বেরিয়ে পড়লাম।
লেখক: সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান