তিনি কোন মানের লেখক?
ডা. মো. তাজুল ইসলাম
আবুবাকার নামা (ভুল করে কেউ আকবরনামা পড়বেন না) এবং ফেসবুকিং ও চিত্ত-জ্বালা বনাম চিত্ত বিনোদন কোনোভাবেই এই বিষয়ে লিখতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু বিষয়কে এড়িয়ে যাওয়া অন্যায় বলে মনে হয়। অপ্রিয় হওয়ার ভয় আমার কখনো ছিল না। এমনকি রীতিমতো ঝুঁকি নিতেও কার্পণ্য করিনি। ফেসবুক ব্যবহারে ফেসবুক এডিকশন, অসামাজিক-অনৈতিক কাজ ও অপরাধসহ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমস্যা বেড়েছে এটি অনস্বীকার্য। তথাপি গণমানুষের মনন পঠনের জন্য এটি একটি উত্তম মাধ্যম। (অন্তত আমার জন্য ফেসবুক আশীর্বাদ)।
ফেসবুকে সাম্প্রতিককালে বাঙাল বনাম বাঙালি, ভদ্রলোক বনাম ভদ্দর লোকের সাহিত্য নিয়ে বেশ পা-িত্যপূর্ণ, ব্যঙ্গ-রসাত্মক আলোচনা দেখছি। আমি সব ধরনের পোস্টই পড়িÑ আমজনতা থেকে বিশিষ্ট প-িতদের। নিজের ‘বি পজিটিভ বি হ্যাপি’-এর লেখাই অনেক জমা, তাই ইচ্ছে থাকলেও অন্য সামাজিক ইস্যুগুলো নিয়ে পোস্ট দিতে পারি না (যদিও আমি সব বিষয়েই যথেষ্ট উৎসুক ও আগ্রহী মানুষ)। এত বড় ভূমিকা দেওয়ার কারণ চিন্তাশীলতা ও বিবেকবোধ মাঝে মধ্যে বাধ্য করে কিছু বিষয়ে কিছু না কিছু বলতে (যেমন যথেষ্ট ঝুঁকি সত্ত্বেও তরুণ ডাক্তারদের আন্দোলন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে একটি বড় লেখাই লিখে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস তা বরং যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল।) আবুবাকার নামে বাংলাদেশে একজন অতি জনপ্রিয় লেখক রয়েছেন অনেকের মতোন আমিও তা জানতাম না। যেমন একসময় গায়িকা মমতাজ বা হিরো আলম বলে হিরো আছে তাও জানতাম না। মমতাজ কিন্তু অগোচর থেকে শুধু গোচরে আসেনি, নিজ প্রতিভা বলে একটি বড় ও সম্মানজনক আসন পেয়ে গেছেন (অনেকে প্রতিভা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন, তা ভিন্ন মত থাকবেই)। হিরো আলম উৎকট নারসিসিজম এর ক্যারিকেচার দেখিয়ে প্রচারে চলে এলেও খুব যে বড় অবস্থান দখল করে নিতে পেরেছেন বলা যাবে না (এখানেও কেউ ভিন্ন মত দিতে পারেন যে না সে ভালো অবস্থানেই পৌঁছতে পেরেছেন)। কিন্তু সাম্প্রতিক আবুবাকার নামক লেখক নিয়ে শেষ মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু উনাকে নিয়ে কারও পক্ষপাতিত্ব আবার কারও চিত্ত জ্বালা ও চিত্ত বিনোদনের যে হিরিক পড়েছে সেটি নিঃসন্দেহে চিত্তাকর্ষক বটে।
এক. তিনি কোন মানের লেখক? তিনি কি রবীন্দ্রনাথ বা শেকসপিয়র তুল্য? ১ম শ্রেণির, ২য় শ্রেণির না.., ৩য়, ৪র্থ শ্রেণির? শ্রেণি মাপার মানদ- কি? বলবেন আমরা শ্রেণি বিবেচনা করিনি, তাহলে কোন বিবেচনায় তিনি হাস্যকর লেখক মনে হলো? নিসঙ্কোচে তিনি রবীন্দ্রনাথ তুলনীয় নয়, এমনকি ১ম শ্রেণিরও নয় (হলে এত বছরে বিশ্বনন্দিত না হোক, দেশ নন্দিত হতেন। কেননা তিনি অনেক পুরনো লেখক, উনার বই প্রকাশ্যে বহুল পঠিত ছিল কিন্তু সুধীজনের দৃষ্টি কাড়তে পারেননি। না পারার কারণ তিনি স্বল্পশিক্ষিত বা মোল্লা টাইপের বা গ্রাম্য এ রকম কোনো শ্রেণিবিদ্বেষ নয়। মানসম্পন্ন লেখা বাজারে বের হলে এবং বহুল প্রচারিত হলে কয়েক মাস না হোক কয়েক বছরে তা কোনো না কোনো গুণী ব্যক্তির চোখে পড়তো। আবার সমসাময়িক স্তরের চেয়ে অনেক উচ্চমাপের বলে বর্তমানে তিনি স্বীকৃতি পাচ্ছেন না (যেমনটি ঘটেছিল জীবনানন্দ এর বেলায়) ব্যাপারটি তেমন ভাবারও কারণ নেই (ছিদ্রান্বেষীরা এখানেও প্যাচ দিতে পারেন)। যারা উনাকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও হাসি-তামাশা করছেন তারা নিশ্চয় উনাকে রবীন্দ্র তুল্য বা ১ম শ্রেণির সাহিত্যিক ভেবে তা করছেন না। তারা নিজেদের উচ্চ মার্গের পাঠক না ভাবলে উনাকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করবেন কেন?। লাখ লাখ পাঠক-পাঠিকা যার (যেমনটি প্রচারিত হয়েছে) তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রƒপ করা মানে, তার পাঠক-পাঠিকার চেয়ে উনারা নিজকে উচ্চ মার্গের পাঠক-পাঠিকা ভাবছেন। (উঁচু মান নিয়ে হাসি তামাশা হয় না নিম্ন মান নিয়ে? এটিও ব্যাখ্যার দরকার আছে?) দুই. তথাকথিত উচ্চমানের লেখক ও পাঠক বনাম নিম্নমানের লেখক ও পাঠক থাকলে এদের মধ্যে শ্রেণিভেদও আছে। তখন উচ্চভাবা ব্যক্তিরা যদি নিম্নমানের লেখক/পাঠককে ব্যঙ্গ করে সেটিকে কি শ্রেণিবিদ্বেষ বলা যাবে না? তিন. তারা আবার বলেন মান বা শ্রেণির জন্য নয়, উনি ইসলাম ধর্মকে পুঁজি করে উপন্যাস লিখে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন তাই উনার জাত- গোষ্ঠী উদ্ধার করা নাজায়েজ না। হুমায়ূন আহমেদ ওমুক করে, শরৎচন্দ্র তেমন করে বা ওই লোক যৌনতা সম্বল করে বা তসলিমা পুরুষ বিদ্বেষ কাজে লাগিয়ে জনপ্রিয় হয়েছেনÑ তা আপনাদের গা জ্বলবে কেন? আপনারাও পারলে তেমন কিছু ব্যবহার করে জনপ্রিয় হয়ে যান, কেউ মানা করছে? চার. সবচেয়ে বড় অভিযোগ উনি বোরকা পরে প্রেম করাসহ ধর্মীয় স্টাইলে প্রেম-যৌনতা করা যায় এই প্রলোভন দেখিয়ে মুসলিম তরুণ-তরুণীদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছেন যা পুরো ইসলাম পরিপন্থী ও ধর্ম অবমাননার সামিল। তারা বলেন শ্রেণিবিদ্বেষ নয়, নিম্নমানও নয়, আমরা তার বিরুদ্ধে বলছি তিনি ইসলামি পন্থায় প্রেম যৌনতা করা যায় এমন না হোক, ইসলাম বিরোধী কাজ করেছেন। নাউজুবিল্লা বিবাহপূর্ব প্রেম যৌনতাকে উনি জায়েজ করার চেষ্টা করেছেন। কত বড় নাফরমানি কাজ?। সাবাশ, হাত তালি দিতে হয় এসব ইসলাম প্রিয় ধার্মিক মানুষদের। ইসলাম ধর্মের এত বড় অবমাননা কেমনে তারা সইবে? তাই উনারা এই বক ধার্মিক আবুবাকার-এর বিরুদ্ধে জিহাদের অংশ হিসেবে এ রকম সমালোচনা, বিদ্রƒপ করছেন। তবে আফসোস হেফাজত বা জামায়াত বা আইএসসহ কেউ এই ইসলাম ধর্ম বেচে ও ইসলাম ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে প্রেম যৌনতার মতোন অতি গর্হিত বিধর্মী কাজের বিরুদ্ধে ওই লোকের ফাঁসি চাওয়া দূরে থাক, তার বিপক্ষে একটি বাক্যও ব্যয় করছে না। তাই বাধ্য হয়ে এই সেক্যুলার, অসাস্প্রদায়িক গোষ্ঠীকেই ইসলাম ধর্মকে অপব্যবহার থেকে রক্ষার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। মহান আল্লাহ উনাদের এই ইসলামি জিহাদকে কবুল করুন। সবাই বলুন আমিন।
পাঁচ. উনাকে দেখে ও জেনে এটি বোঝা কঠিন নয় যে উনি সাধারণ মানের একজন মুসলিম লেখক (কেননা উনি নাকি মুসলিম সংস্কৃতি ধারণ করে উপন্যাস লিখেছেন)। দস্যু বনহুর এর লেখিকা বা আনোয়ারা উপন্যাস লেখক ও একটি শ্রেণির ও একটি নির্দিষ্ট বয়সের পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন (৭ম-৮ম শ্রেণিতে থাকাকালীন আমিও রাত জেগে এসব বই পড়েছি)। আবুবাকার সম্ভবত সে মানেরই একজন লেখক, তবে অনেক বেশি জনপ্রিয়। লক্ষণীয় উনি নিজে নিজের প্রচারে কখনো নেমেছে বলে শুনিনি (যা আমরা অনেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করি)। সাক্ষাৎকারে ও আত্মপ্রচার বা আত্মরম্ভিতার কোনো লক্ষণ ছিল না। সব ব্যাপারেই সাদামাটা, সাধারণ। উনাকে কোনো গোষ্ঠী বিশেষ উদ্দেশে প্রচারে নিয়ে এসেছে কিনা সে নিয়ে আরেকটি গোষ্ঠী উৎকণ্ঠিত। এটি ঠিক এই প্রচারে উনার নাম খ্যাতি বেড়েছে এমনকি আপাত অনেকের কাছে অনেক বড় লেখকও মনে হতে পারে। কিন্তু এতে উনার কোনো হাত নেই। উনি আমাদের অনেকের মতোন এত বড় সুযোগকে কাজে লাগানোরও কোনো চেষ্টা করছেন না। তবে কেন বিদ্বেষ? কেন হাসি-তামাশা? (তার লেখার মান বা বিষয়বস্তু নিয়ে সমালোচনা এক কথা, আর তাকে ক্লাউন বানিয়ে মসকারা করা ভিন্ন কথা। তাকেই ক্লাউন বানানো যায় যিনি কথায়, আচরণে এমন কিছু করেন যা বিরক্তিকর, আপত্তিকর ও অন্যের জন্য অপমানজনক। যেমনÑ ট্রাম্প, এরশাদ, হিরো আলম)।
যারা জ্বলে-পুড়ে মরছেন এটি ভেবে এমন লেখক এত বড় প্রচারণা কেন পাবে, কেন এত বড় মাপের লেখক বলে দেশ-বিদেশে প্রচার হবে, তাদের একটি ধৈর্য ধরতে বলবো। সময়ের বিচারে কোনটি স্বর্ণ আর কোনটি নিছক পাথর তা নির্ণিত হয়ে যাবে। আবুবাকার আবুবাকারই থাকবেন। তাকে কেউ উচ্চে বা কেউ নিম্নে নিয়ে যেতে পারবেন না (তাহলে এরশাদ সাহেব নিজ প্রচারেই মহান কবি হিসেবে ইতিহাসে নাম লিখে যেতে পারতেন)।
লেখক: অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
সম্পাদনা: আশিক রহমান