শব্দের বিপদজনক শক্তি
ফাহমিদা হক
বাঙালিদের জীবনে হাজারো অভাবের সবচেয়ে বড় অভাব জ্ঞানের অভাব। কারণ আমরা দেখেও দেখি না, বুঝেও বুঝতে চাই না। এই যে, ভোর ছয়টা সাতটায় রাস্তায় বের হলেই মনে হয় এ যেন শব্দের শহর। হাজারো রকমের বিকট শব্দের যেন প্রতিযোগিতা চলছে, কে কার চেয়ে বেশি এবং জোরে বাজাতে পারে গাড়ির হর্ন। যদিও আমরা সবাই জানি এত শব্দ আমাদের বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার জন্যই ক্ষতিকর। তারপরেও কারও হুঁশ নেই, অকারণে নিজের এবং চারপাশের পরিবেশটাকে দূষিত না করতে একটুও বিবেক কাজ করে না কারও। আমরা আমাদের বীর বাহাদুর ড্রাইভারকে বলতে পারি না অকারণে গাড়িতে হর্ন বাজানো উচিত না।
শব্দ পরিবেশের কোনো খারাপ উপাদান নয়। বরং শব্দ আমাদের জীবনযাপনের জন্য এক অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু শব্দ দূষণ পরিবেশের এক চরম বিরক্তিকর উপাদান। জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় একটি হুমকি এই শব্দ দূষণ। সবকিছু জেনে, বুঝে-শুনেও নিজেদের অজান্তেই নিজের ক্ষতি করেই চলছি সবাই মিলে। রাজধানী শহর ঢাকার এমন কোনো নাগরিক হয়তো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে যে শব্দ দূষণের শিকার হয়নি। শব্দ দূষণ এমন এক মহামারি আকার ধারণ করেছে যে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এখান থেকে বের হওয়া যাবে না, কিন্তু আসলে এটা রোধ করা এমন কঠিনও কিছু নয়। এর জন্য দরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সবার আন্তরিকতা ও এর বাস্তবায়ন।
বায়ু ম-লের মধ্যে শ্রুতিসীমা বা সহনক্ষমতা বহির্ভূত অপেক্ষাকৃত উচ্চ-তীব্রতা বা তীক্ষ্মতাসম্পন্ন শব্দের উপস্থিতিতে জীব ও পরিবেশ তথা মানুষের উপর যে অসংশোধন যোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়, সেই পরিবেশ সংক্রান্ত ঘটনাকে শব্দ দূষণ বলে। অন্যভাবে বলা যায়, যেমন বজ্রপাত অথবা মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে যে বিকট শব্দ, যা সাধারণভাবে, মানুষের শ্রবণসহন ক্ষমতার বাইরে ও মানুষের শ্রবণশক্তির উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে এবং মানুষের মস্তিষ্ক ও দেহে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে তাকে শব্দ দূষণ বলে। শব্দের দূষণ বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমনÑ যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার, মাইকিং, অনুষ্ঠানের নামে হাই ভলিউমে মিউজিক চালানো, কলকারখানার সৃষ্ট শব্দ, বাড়ি তৈরিতে সৃষ্ট শব্দ, রেডিও, টিভি, সিডি, টেপ রেকর্ডার জোরে সাউন্ড দিয়ে শোনা বা দেখা ইত্যাদি নানান কারণে শব্দ দূষণ হয়। বাহ্যিকভাবে শব্দ দূষণ তেমন কোনো ক্ষতিকর মনে না হলেও এটি মানুষের ভয়ানক ক্ষতি করে থাকে নীরবে। এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে শতকরা একশ ভাগ লোকই শব্দ দূষণের শিকার। পরিবেশ অধিদফতরের জরিপ অনুযায়ী, সহনীয় মাত্রার চাইতে বেশি শব্দ মানুষের মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতার সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত শব্দ উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, মাথাধরা, বদহজম, পেপটিক আলসার এবং অনিদ্রার কারণ ঘটায়। যেকোনো ধরনের শব্দ দূষণ সন্তানসম্ভাব্য মায়ের জন্য গুরুতর ক্ষতির কারণ। পরীক্ষায় দেখা গেছে, লস এঞ্জেলেস, হিথ্রো এবং ওসাকার মতো বড় বিমানবন্দরের নিকটবর্তী বসবাসকারী গর্ভবতী মায়েরা অন্য জায়গার চাইতে বেশি সংখ্যক পঙ্গু, প্রতিবন্ধী ও অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেয়। ক্রমাগত শব্দ দূষণের ফলে চরম ক্ষতি হয় কানের।
পরিবেশ গবেষক কাজী হেদায়েতুল ইসলাম বলেছেন, শব্দদূষণের ফলে মানসিক ভীতি, শারীরিক বিপত্তি ঘটে থাকে, শ্রবণশক্তি কমে যায়, বধির হবার অবস্থা সৃষ্টি হয়। শব্দদূষণ রোধে আমাদের দেশে আইনের কমতি নেই। কমতি রয়েছে তা প্রয়োগের, ২০০২ সালের ২৭ মার্চ উচ্চ আদালত হাইড্রোলিক হর্ন এবং বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী যেকোনো ধরনের হর্ন গাড়িতে সংযোজনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং গাড়িতে বাল্ব হর্ন সংযোজনের নির্দেশ প্রদান করেন। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ আইন অনুযায়ী নীরব এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবল এবং রাতে ৩৫ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবল এবং রাতে ৪০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবল ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবল ও রাতে ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবল ও রাতে ৭০ ডেসিবলের মধ্যে শব্দের মাত্রা থাকা আবশ্যকীয় বলা আছে। এই আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে নীরব এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এর পরও শব্দ দূষণ কমছে না বরং দিনদিন তা বেড়েই চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৩০টি কঠিন রোগের উৎস ১২ রকমের পরিবেশ দূষণ, এর মধ্যে অন্যতম শব্দদূষণ । মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, তোমরা তোমাদের নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংস করো না। হাসপাতালের ৫-৭ ভাগ রোগীই অতিমাত্রায় শব্দের ভুক্তভোগী, শব্দ দূষণের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ শ্রবণশক্তির মতো একটি বড় নিয়ামত থেকে আজীবনের জন্য দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, এই একই কারণে সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুকাত এর মস্তিষ্কের বিকৃতি হচ্ছে। একজন মানুষের উপর এর চেয়ে বড় জুলুম কি হতে পারে! এখানে লক্ষণীয় হলোÑ যারা দূষণকারী তারাও দূষণের শিকার। তাই শুধু সরকারের উপর দায় দিয়ে নয় নিজেদের ও সরকারের প্রণীত আইন মেনে, জনসচেতনতা সৃষ্টি করে, দ্রুত শব্দদূষণ রোধের প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করতে হবে। সারাবিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখনই সবাইকে সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য, বসবাস উপযোগী নগর গঠনে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: পরিচালক, সিসিএন
সম্পাদনা: আশিক রহমান