বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
স্বাধীন মতপ্রকাশের সকল বাধা এদেশে এখনো দূর হয়নি। প্রশাসন ও শক্তিধর মহল থেকে এক্ষেত্রে কিছু কিছু বাধা এখনো রয়েছে এটা কোনো গবেষণা ছাড়াই বলা যায়। এদের বিরুদ্ধে মিডিয়া ও সুশীল সমাজ প্রায় সোচ্চার। কিন্তু তথ্য বিকৃতিকারী, উসকানিদাতা ও চক্রান্তকারীদের ব্যাপারে কেউ কথা বলে না। এখন পর্যন্ত ৩৫টি অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করা হয়েছে বলে জানা গেলেও এর কোনোটাই সরকার বিরোধিতার জন্য বন্ধ করা হয়নি, বরং ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক লেখা এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুস্পষ্ট ইন্ধন জোগানোর অভিযোগে প্রশাসন পোর্টালগুলো বন্ধ করে যা সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনের সুনির্দিষ্ট ধারা মোতাবেকই করা হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যতটুকু চাপের মধ্যে আছে সেটা নন-স্টেট অ্যাক্টিভেস্টদের পক্ষে থেকে, মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদীদের কাছ থেকে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চাপের অনুপস্থিতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনটি সবকটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। গণমাধ্যমের সংখ্যা বৃদ্ধিকেই অনেকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মাপকাঠি হিসেবে মানতে না চাইলেও এটা বলা যায় যে, শতশত পত্রিকার অনুমোদন, অনলাইন ও এফএম রেডিও, কমিউনিটি রেডিও, প্রায় ৩০টি প্রাইভেট টিভির অনুমোদন দিয়ে সরকার কোনোভাবেই লাভবান হয়েছে বলে জানা যায়নি। রাজনীতিক, সংবাদকর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ নির্দ্বিধায় তাদের নিজেদের মতামত ব্যক্ত করছেন এবং প্রায় সব বিষয়ে সবাই সবকিছু স্বাধীনভাবে বলছেন বা লিখছেন। টিভি লাইভ টকশোগুলো দেখলে এ ব্যাপারে কারও কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কোনো এডিটিং ছাড়াই যে যা বলছেন তা সরাসরি সম্প্রচার হয়ে যাচ্ছে। কেউ বাধা দিচ্ছে না। তারপরও যারা বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ হয়ে আছে বলে অপপ্রচার চালাচ্ছেন তাদের যে অন্য মতলব আছে সেটা বুঝতে কারও বাকি থাকে না। মজার ব্যাপার হলো বাকস্বাধীনতা সীমিত হওয়ার বিষয়টি তারা আবার গণমাধ্যমেই বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে হলুদ সাংবাদিক, তথ্য বিকৃতকারী, উসকানিদাতা ও চক্রান্তকারীরা চাপে রয়েছে। কোনো সংবাদ মাধ্যম বা সাংবাদিক চাপে নেই। বাংলাদেশের গণমাধ্যম কখনো বর্তমান সময়ের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেনি। এটা অস্বীকার করা যাবে না সাংবাদিক হত্যার বিচার দ্রুত করা যায়নি বা যাচ্ছে না। হুমায়ুন কবীর বালু, মানিক সাহা, শামসুর রহমান, মীর ইলিয়াস, হোসেন দীলিপ, শেখ বেলাল উদ্দীন, প্রবীর সিকদার, সৈয়দ নাজমুল ইমাম, সাগর-রুনিসহ অনেক নিহত ও নির্যাতিত সাংবাদিকদের মামলাগুলো দ্রুত এবং সঠিক বিচার হয়নি বা বিচারই শুরু হয়নি। সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
‘সাংবাদিকদের নিরাপত্তা এবং দেশের নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে’ লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর্টিকেল ১৯-এ যে সকল সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে তার মধ্যে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হওয়া সকল সহিংসতা দ্রুত ও কার্যকর তদন্ত করা, সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্টদের নিজ নিজ কাজ করার জন্য নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টি সরকার ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন করেছে। তাছাড়া, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক আলোচনা হবে, সমালোচনা হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এখানে বলে রাখা ভাল ‘মুক্ত গণমাধ্যম’ বিষয়ে যে পরিমাণ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে এতেই প্রমাণ হয় বাংলাদেশের গণমাধ্যম মুক্ত ও স্বাধীন।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম অতীতে অনেক চাপের মধ্য দিয়ে কাজ করেছে। স্বাধীনতার পর নানা চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে গণমাধ্যমকে। কখনো গণতান্ত্রিক শাসকদের কবলে পড়েছে, আবার কখনো সামরিক শাসক। আর সঙ্গে মালিকানা ও বিজ্ঞাপনের চাপ তো বরাবরের। সাংবাদিকদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক বিভাজনে জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের এই বিভাজিত রাজনীতি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অন্তরায়। তাদের মধ্যে যখন রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি হয় তখন কিছুই করার থাকে না। সাংবাদিকদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি ও সুবিধাগ্রহণের মানসিকতা কখনো বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে পেশাদার হতে দেয়নি। তথাপি বিভিন্ন প্রতিকূলতা ও ঝুঁকি সত্ত্বেও গণমাধ্যম দেশে গণতান্ত্রিক বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে অমূল্য অবদান রাখছে। এই ভূমিকা অব্যাহত রাখতে সাংবিধানিক অঙ্গীকার অনুযায়ী গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা ও গণমাধ্যম কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা, সুশাসন, জনকল্যাণমুখী, অংশগ্রহণমূলক এবং টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়া মজবুত করতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় এমন সব ধরনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ ও সংবাদকর্মীদের ওপর হয়রানি বন্ধ করা, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের উপযোগী পরিবেশ উত্তরোত্তর বিকাশ নিশ্চিত করা সরকারের যেমন দায়িত্ব তেমনি নিরপেক্ষ সাংবাদিকতাও মুক্ত গণমাধ্যমের একটি অপরিহার্য অংশ বিশেষ।
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান