মা সাথে বন্ধনও গেছে
প্রতীক ইজাজ
উৎসব মানেই বাড়ি ফেরা। মা তাকিয়ে থাকবে পথে। সময় গড়াবে। শ্লথ হবে কাজের গতি। জায়নামাজে বসে কান থাকবে দরজার দিকে। কখন টুক করে শব্দ হবে। ক্যাচক্যাচ খুলবে দরজা। ‘মা’- বলে ডাকবে তার আদরের ছেলে।
মাঝে মধ্যে বাড়ির বড় ছেলের ছোট মেয়েটা মাকে নানা অনুযোগ করতো। অভিযোগ দিত। ‘দাদি দাদি’- বলে জোগান দিত তথ্যের। মা কিছু বুঝতো। কিছু বাক্য মিলিয়ে যেত কচিমুখের দাঁতের ফাঁক দিয়ে। মা হাসতো। নাতির চাঁদমুখে চুমু একে বলতোÑ ওতো আমার ছেলে। তুই যেমন ওর মেয়ে। ওর কি কোনো দোষ থাকতে পারে বল!
বহুদিন আমাদের পাতে ইলিশের ডিম ওঠেনি। মাছের পেটিটাও তোলা থাকতো মেজদার জন্য। মা বলতো, জানিস তো, ও আমাদের জন্য কত কষ্ট করে। আমরা মার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আর ভালবাসা বেড়ে যেত মেজদার জন্য।
বার্ষিক পরীক্ষার পর মা আমাদের নিয়ে ছুটতেন গ্রামে। বিক্রমপুরে। মূলত নানার বাড়ি। সারেং বাড়ির মেয়ে। কত সম্মান তার। গ্রামে পা ফেলা মাত্রই পিপড়ার সারির মতো মানুষ আসতো। ফুফু, নানু, আপা, ভাবি, সেলিনা। কত সম্পর্ক, কত চেনাজানা, কত স্মৃতি। কাগজের ঢোঙা থেকে মা বিস্কুট বের করে বিলাতেন। আর আমাদের চেনাতেন আলপথ, হলুদ শর্ষে ফুল, বোত্যা শাক। আর গোসল করার নামে বাঁধানো পুকুর ঘাটে ডুব দিতেন সন্তানদের নিয়ে। সাঁতার শেখাবেন। যেবার মা গেল, সঙ্গে গেল বন্ধন। এখন আর বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। নাতিটা বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ভাতে খায় পাতভর্তি ইলিশের ডিম। মেজদাটা জায়নামাজে বসে চোখের জল ফেলে। গ্রাম থেকে ফোন করতো যে মেজ মামা, সেও গেছে। শানবাধানো পুকুর ঘাটের হিজল গাছে বাঁধা থাকে নৌকা। বছরের পর বছর যায়। ওদিকটায় পা পড়ে না।
এখনো উৎসব আসে। রান্না হয়। মেহমান আসে। দিনরাত ব্যস্ত থাকে বাড়ির মেয়েরা। কেবল মা নেই। তার আদরে আমড়া গাছটা কাটা গেছে গত বর্ষায়। বাগানের খালি জায়গাটুকু বিক্রি হয়ে গেছে। রোজ সকালে তসবিহ গুনতে গুনতে যে জামরুল ফলে হাত বুলাতো মা, সেখানে এখন ঘরের জানালা। আর তাকের বয়ামে রাখা পূজার বাতাসা, এখন বাতাসে খায়!
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান