‘আরবান’ ঢাকা ‘অরফান’ মানুষ ও ভেড়ার সংখ্যা
কাকন রেজা
১৯৮৬ সালের সকাল। ঢাকার এক খ্যাত সাংবাদিকের ল্যান্ডফোন বাজলো। ওপাশ থেকে মফস্বলের কারও উদ্বিগ্ন প্রশ্ন, ঢাকায় নাকি গুলি হয়েছে, ভার্সিটিতে অবস্থা নাকি খুব খারাপ? সকাল সকাল উটকো আলাপ, ঘুমের ঘোর না কাটা সাংবাদিকের উত্তর, খেয়েদেয়ে কাজ নেই, সকাল বেলাই দেশোদ্ধার, ওইটা তো আমার ‘বিট’ না। স্যরি ভাই, বুঝতে পারি নাই, ঘুমের ডিস্টার্বের জন্য আবার স্যরি। না না ঠিক আছে।
টুইন টাওয়ার বিধ্বস্ত, ঢাকায় একটি সেলফোনে রিং। ভাই আমেরিকায় নাকি বিমান থাইকা বোমা মাইরা উঁচা বিল্ডিং ভাইঙ্গা ফালাইছে? কেবল পাঁচ তারকার ফ্লোরে স্টেপিং শুরু এর মধ্যেই হড়কালো। ধুর মিয়া, কী বলেন সব, যখন তখন ফোন করেন। আমেরিকায় যুদ্ধ শুরু হলে আমার থেকে আপনি আগে খবর পান, যত্তসব। স্যরি ভাই, টেলিভিশনে কইলো, তাই জিগাইলাম। ঠিক আছে। এটা কোনো রূপকল্প নয়, ম্যাজিক রিয়েলিটি নয়, বিশুদ্ধ বাস্তবতা। ল্যান্ড ও সেল দুটি ফোনই এসেছিল ঢাকাবাসী দুজন খ্যাত সাংবাদিকের কাছে। যারা জানতে চেয়েছিলেন উদ্বিগ্নতায় তারা বিফল হয়েছেন খবরটি নিশ্চিত হতে। কিন্তু যারা নিশ্চিত করতে পারতেন তারা ব্যর্থ হয়েছেন নিজ অজ্ঞতায়।
যেমন ব্যর্থ হয়েছেন প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ও তার অধঃস্থনরা। বিপর্যস্ত হাওরে যখন মাছ মরে, জলজ প্রাণী মরে, ডাঙায় মরে গবাদি পশু তখন তারা ভেড়া বিষয়ক সেমিনারে দেশের বাইরে। দুই সাংবাদিক ব্যর্থ হয়েছিলেন খবর জানতে ও জানাতে, তেমনি ব্যর্থ হয়েছেন মন্ত্রী এবং তার সাঙ্গরা। হাওরের দুর্দশার সঙ্গে ভেড়া বিষয়ক ভ্রমণ যোগ করে সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা একটি চমৎকার লেখা লিখেছেন। তবে ‘ভেড়ার সংখ্যা ৭টি কম ১৬ কোটি’ শিরোনামে সেই লেখাটির হিসাবে কিছুটা অসঙ্গতি রয়েছে। বেয়াদবি ক্ষমা চেয়ে বলি, সাতটির সঙ্গে আরও কিছু যোগ হয়ে বাড়বে কম পড়া ভেড়ার সংখ্যা। যদিও জানি এ সংখ্যা সাত থেকে সত্তর বা তিনশ সত্তর হলেও কিছু আসে যাবে না। মাঝে মধ্যে এমন কমবেশি হতেই পারে। ইদানিং কিছু পাঠার হিসাবও কানে ভেসে আসছে। নাদুসনুদুস কিছু পরদেশি রামপাঠা নাকি খেয়েদেয়ে নিশ্চিন্তে চড়ে বেড়াচ্ছে দেশে! আর এদের হাতে নাকি ‘৭টি কম ১৬ কোটি’ ভেড়াদের লোম বাণিজ্য, একেবারে চামড়া রেখে সব লোমই উজাড় করে নিয়ে যাচ্ছে!
ভেড়া আর পাঠা প্রসঙ্গ গোপাল ভাঁড়ের ‘কাউয়া’র ‘গপ্পো’ মনে পড়ে গেল। রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র গোপালকে রাজ্যের কাক গণনা করতে বললেন। সময় বেঁধে দিলেন সাতদিন। না পারলে গর্দান। রাজা ছয়দিনের মাথায় বললেন, কী গোপাল তোমার কাক গোনা কতদূর। মহারাজ হিসাব পাবেন কালকেই। পরদিন রাজসভায় গোপাল বিশাল একখানা খাতা নিয়ে হাজির। মহারাজ এই যে কাকের হিসাব। কৃষ্ণচন্দ্র শুধালেন এত শুধু হিজিবিজি সংখ্যা লেখা, হিসাব কই। ওই তো হিসাব মহারাজ। ওই যে লেখা কাকের সংখ্যা ১৬ কোটি ১৬ লাখ ১৬ হাজার ১৬’শ ১৬টি। তবে মহারাজ এর চেয়ে যদি কম হয় তবে ভেবে নিবেন এদের মধ্যে কেউ কেউ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইটজারল্যান্ড ভ্রমণে গেছে, আর বেশি হলে বৈদেশে কাজে যাওয়া ‘কাউয়া’র একাংশ অর্ধচন্দ্রে ফিরে এসেছে। এবার গুনে দেখতে পারেন মহারাজ। মোর্তোজা ভাইও গুনে দেখতে পারেন।
‘আরবান’ ঢাকায় যারা বসবাস করেন তাদের ‘অরফান’ কেন বললাম, এমন প্রশ্ন উঠতে পারে। এটা জানাতে নিজের একটি ঘটনা বলি, সেটাও ১৯৮৬’র। তখন স্বৈরাচার হঠাও আন্দোলন চলছে, কেবল কলেজে পড়ি উৎসাহ প্রচুর। দিনে মিছিল-মিটিং, সন্ধ্যা হলেই রেডিওতে বিবিসি ধরে বসে থাকি। মফস্বলের মানুষের কাছে তখনকার বিবিসির ক্রেজ এই চ্যানেলের যুগে বলে বোঝানো যাবে না। মজার বিষয় হলো সে সময়ে ঢাকা থেকে আত্মীয়-স্বজন পরিচিতজনরা অনেকেই রাতে ল্যান্ডফোনে খবর নিতেন পরদিন হরতাল আছে কি না, কাজে যাওয়া যাবে কি না, দেশের অবস্থা কী, ইত্যাদি। দেশে থেকেও যেন প্রবাসী তারা। সত্যিকার অর্থে আজোবধি এটাই ঢাকাবাসী’র, ঢাকাবাসে’র সংখ্যাগরিষ্ঠ চিত্র। তখনকার আরেকটি ঘটনা। আমাদের পরিচিত এক বড় ভাই ঢাকায় থাকেন চাকরির সুবাদে। তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনি যেখানে ভাড়া থাকতেন সেখানে ল্যান্ডফোনে খোঁজ নিলেও কেউ কিছু বলতে পারলেন না, এমনকি তার পাশের রুমের ভাড়াটিয়াও নয়। না কোনো উদ্বেগজনক ঘটনা ছিল না, তিনি কোম্পানির কাজে দুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে গিয়েছিলেন। সেলফোনের সময় হলে হয়তো এমন উদ্বেগ থাকত না। কিংবা আরও বেশি থাকতো। বর্তমানে সেলফোন দীর্ঘক্ষণ বন্ধ থাকাটাও উদ্বেগের বিষয়। এখনো আপনি কারও খোঁজ চাইবেন, কেউ দিতে পারবে না। অন্যের জন্য এতটা সময় নেই এই নগরবাসীর। সুতরাং ‘আরবান’ ঢাকার মানুষদের ‘অরফান’ বলবো না কী বলবো! তারা তো নিজেরা হারিয়ে গেলেও কেউ খবর দেবে না বা নেবে না। শুধু কান্না চেপে খুঁজবে পরিবারের মানুষ। তাহলে কী এই ‘আরবান’ ঢাকায় আপনি ‘অরফান’ নন?
সাংবাদিকদের কথায় আসি। অতি সম্প্রতি কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের একটা ফেসবুক মন্তব্য দেখলাম। তিনি লিখেছেন, ‘একইসঙ্গে বিত্তের কান আর ক্ষমতার পিঠ চুলকাতে না জানলে এ যুগে বিখ্যাত সাংবাদিক হওয়া যায় না।’ জানি দুষ্টু লোকেরা বলবেন, ‘ফ্রুটিকা একটু বেশিই পিওর’। তবে কথাটা কিন্তু বেড়ে বলেছেন। এ প্রজাতির কেউ কেউ বিখ্যাত হবার নেশায় এত মত্ত হয়ে উঠেন যে স্থান, কাল, পাত্র সবই ভুলে যান। এমনকি ভুলে যান আলোচনা আর স্তুতির পার্থক্যও। প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ প্রয়াত শামসুর রাহমান সম্পর্কে তার প্রবচন গুচ্ছে বলেছিলেন, ‘শামসুর রাহমান বোঝেন না কার সঙ্গে পর্দায়, আর কার সঙ্গে শয্যায় যেতে হয়।’ তেমনি আমাদের অনেকেই তা বোঝেন না।
ইনাদের কেউ বিত্তের কান চুলকাতে গিয়ে নিজের কানে দেন তুলো। ফলে কানে আর কোন খবরই ঢোকে না। সঙ্গে ক্ষমতার পিঠ চুলকাতে নিজের পিঠে বাঁধেন কুলো, যাতে কর্তব্যের আঘাত পিঠে না বাজে। বিত্ত ও ক্ষমতার নাগাল পেয়ে গেলে তো কথাই নেই। তুলো আর কুলো দুটোই ছুড়ে ফেলেন তারা। তখন কিছুতেই তাদের কিছু যায় আসে না। সত্যিই ‘আরবান’ ঢাকার এমনসব ‘অরফান’দের কিছুতেই কিছু যায় আসে না। আনন্দেও নয়, বিষাদেও না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান